চট্টগ্রাম নগর পুলিশে ওসি নিয়োগে নিয়ম মানার বালাই নেই

পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পদে কমপক্ষে তিন বছর চাকরি করার পরই কেবল সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ওসি পদে নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করবেন। পরিদর্শক হিসেবে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুই বা ততোধিক এবং সমগ্র চাকরিকালে চার বা ততোধিক গুরুদণ্ড থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে পদায়ন করা যাবে না।

থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পদে পদায়নের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি)। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আট দফা নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করেই ওসি নিয়োগ করা হচ্ছে।

এক্ষেত্রে ওসির পদপ্রত্যাশী পুলিশ পরিদর্শকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও নিয়োগকর্তা পুলিশ কমিশনারের রোষানলে পড়ার ভয়ে কেউই মন্তব্য করতে রাজি নন। তবে এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও অনৈতিক তদবিরই প্রধান ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্য পুলিশ পরিদর্শকরা আর পুরস্কৃত হচ্ছেন রাজনৈতিক ও অনৈতিক তদবিরকারী পুলিশ পরিদর্শকরা। এমন অভিযোগ পুলিশ পরিদর্শকদের অনেকেরই। তবে নগর পুলিশের কমিশনার মাহবুবর রহমান এমন অভিযোগ মানতে নারাজ।

জানা যায়, ২০১৬ সালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পুলিশের সকল ইউনিট প্রধানের কাছে ওসি পদে নিয়োগের জন্য আটটি নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ওসি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগীয়ভাবে একটি নীতিমালা অনুসরণ করার জন্য। ওই নীতিমালা অনুসারে ৫৪ বছরের বেশি বয়সের কেউ ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। কারণ, একজন ওসিকে মাঠপর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে সিএমপির অন্তত তিনটি থানার ওসির বয়স এখন ৫৪ বছরের বেশি। এছাড়া সদর দপ্তরের নির্দেশনায় ১২ বছরের বেশি সময় ওসি পদে দায়িত্ব পালনে নিরুসাহিত করা হলেও ওই তিন ওসিই ১২ বছরের বেশি সময় ধরে ওসির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছে যেভাবে

পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পদে কমপক্ষে তিন বছর চাকরি করার পরই কেবল সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ওসি পদে নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করবেন। পরিদর্শক হিসেবে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুই বা ততোধিক এবং সমগ্র চাকরিকালে চার বা ততোধিক গুরুদণ্ড থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে পদায়ন করা যাবে না। আর কারো বিরুদ্ধে একটি আর্থিক অনিয়ম বা নৈতিক স্খলন সংক্রান্ত গুরুদণ্ড থাকলেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ওসি পদে নিয়োগের যোগ্যতা হারাবেন। থানায় পদায়নকৃত পরিদর্শকের মধ্যে সিনিয়রকে ওসি পদে নিয়োগ করতে হবে।

তবে এক্ষেত্রে সিএমপিতে সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। সম্প্রতি সদরঘাট থানার ওসি হিসেবে নিয়োগ পান নগর বিশেষ শাখা (সিটি এসবি) থেকে আসা ফজলুর রহমান ফারুকী। পরিদর্শক পদে তিনি পদোন্নতি পেয়েছেন ২০১৫ সালের একেবারে শেষের দিকে। সেই হিসেবে তিন বছর হলেও তবে কোন থানায় পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নেই তার।

সিএমপিসহ দেশের সকল থানার ওসিদের পরিদর্শক (তদন্ত) পদে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। ওসি পদের কাজই যেহেতু থানা পরিচালনা, সে কারণে ওসি পদে আসার পূর্ব অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্ব পালন করাটা খুবই জরুরি বলে মনে করা হয়ে থাকে।

জানা যায়, উপ-পরিদর্শক হিসেবে ২০০৩ সালে ফজলুর রহমান ফারুকীর নিয়োগ হলেও বিভাগীয় শাস্তি থাকার কারণে যথাসময়ে তার পদোন্নতি হয়নি। তবে সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পদে দায়িত্বরত রুহুল আমীন ২০০৫ সালে নিয়োগ পেলেও পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন বর্তমান ওসি ফারুকীর আগে। দুজনেই ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেলেও ওসির চেয়ে ওসি তদন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন মাসকয়েক আগে। সে হিসেবে পরিদর্শক হিসেবে ওসি ফারুকীর চেয়ে রুহুলের অভিজ্ঞতা বেশি। এমনকি সরাসরি থানায় ক্রাইম নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ওসির চেয়ে পরিদর্শক (তদন্ত) রুহুলের বেশি।

নির্দেশনার উল্টো পথে যাত্রা

সদর দপ্তরের নির্দেশনায় সদাচরণ, গণমুখী ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে উৎসাহী পুলিশ পরিদর্শকদের ওসি হিসেবে পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ওই নীতিমালায় ভবিষ্যতে রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) প্যানেলের অনুসরণে থানার ওসি পদায়নেও একই ধরনের প্যানেল প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই নিয়মও মানা হয়নি কখনোই। উল্টো সিএমপির দু তিনজন ওসি ছাড়া তেমন কোন ওসির মধ্যে এই ধরনের গণমুখী কাজ দেখা না গেলেও ঠিকই তাদের পদায়ন হয়েছে। এমনকি অনেকের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নাম উঠে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, উল্টো তাদের ওসি পদে পদায়ন করে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

এছাড়া পুলিশিং কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে যে কোন ধরনের ভয়ভীতির উর্ধ্বে উঠে কাজ করার সুবিধার্থে পদায়নের পর থেকে ১৮ মাসের আগে কোন বড় অভিযোগ ছাড়া বদলি বা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। তবে সেক্ষেত্রেও পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পুলিশ কমিশনার এ পদক্ষেপ নিতে পারবেন। শুধুমাত্র সম্প্রতি ডবলমুরিং থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া মহিউদ্দিন সেলিম ছাড়া ১৮ মাসের কম সময়ে আরো বেশ কয়েকজন ওসির বদলি বা প্রত্যাহার করা হয়েছে সদর দপ্তরের নির্দেশ ছাড়াই। সম্প্রতি বাকলিয়ায় ওসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া নেজাম উদ্দিন তার আগের কর্মস্থল সদরঘাটে দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ১৫ মাস। এর আগে আবুল কাসেম ভূইয়াকে পতেঙ্গা থানা থেকে প্রথমে বন্দর থানায় বদলি করা হলেও তার কয়েক দিনের মাথায় পাঁচলাইশ থানার ওসি হিসেবে তাকে বদলি করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে ১২ বছরের বেশি ওসির দায়িত্ব পালন করা মহিউদ্দিন মাহমুদকে পাঁচলাইশ থেকে বন্দর থানায় পদায়ন করা হয় আবুল কাসেম ভূইয়ার বদলি হিসেবে। এছাড়া ৬ মাস আগে সদীপ কুমার দাশকে প্রথমে পাহাড়তলী থানায় পদায়ন করা হয়। কিন্তু ছয় মাসের কম সময়ের মধ্যেই তাকে আবার ডবলমুরিং থানায় পদায়ন করা হয়েছে ওসি হিসেবে। এসব বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ সদর দপ্তরের কোন নির্দেশনা না থাকলেও জনস্বার্থে তাদের এ বদলি বা পদায়নের আদেশ দেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশ কমিশনার তার অফিস আদেশে উল্লেখ করেন।

নেপথ্যে কি তদবির?

ওসি পদে নিয়োগের জন্য নগর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), নগর বিশেষ শাখা (সিটি এসবি) ও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পদে কর্মরত অনেক মেধাবী ও চৌকস পুলিশ পরিদর্শক অপেক্ষায় থাকলেও নানা অনৈতিক তদবির ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের যথাযথ স্থানে পদায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এছাড়া পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরানো ছাড়াও ভালো পুলিশিং কার্যক্রম চলমান রাখতে এসব অনিয়ম দূর করার মত দিয়েছেন পুলিশের সাবেক কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা।

আট দফা নির্দেশনার পেছনে মূল ভূমিকা যার

২০১৬ সালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আট দফা নির্দেশনার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছিলেন পুলিশের সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে একেএম শহীদুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওসি নিয়োগে আমি যে নীতিমালা জারি করেছিলাম সেটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে, ওটা আমার ব্যক্তিগত নির্দেশনা ছিল না। ওই সময়ে বাস্তবতার আলোকে অনেক সিনিয়র অফিসারের পরামর্শে এ নীতিমালা জারি করা হয়েছিল। গুড পুলিশিং এবং যোগ্য অফিসারদের পদায়নের জন্য পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বর্তমানেও সেইসব নিয়ম মানা হবে বলে আশা করি।’

সিএমপি কমিশনারের বক্তব্য

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার মাহবুবর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনি যা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক নয়। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নলেজে দিয়ে নিয়মকানুন মেনেই ওসি পদায়ন করা হয়ে থাকে। আমি সবসময় নিয়ম মেনেই এসব কাজ করি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!