দশ বছরেও আদালতের নির্দেশনা মানেনি চসিক

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা ও নীতিমালা জারি করা হলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত ৪৭ স্কুলে তার বাস্তবায়ন নেই। এখনো অধিকাংশ স্কুলগুলোতে গঠন করা হয়নি অভিযোগ কমিটি। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ আদালতের নির্দেশনার কথা অবগত নয়।

চসিকের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়ার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান,‘হয়তো সবগুলোতে নেই। কয়েকটাতে আছে। আসলে নির্দিষ্ট করে আমার জানা নেই।’ তৎক্ষণাৎ অফিস সহকারী সুভাষ চক্রবর্তীকে ডেকে পাঠালে তিনি জানান আমাদের স্কুলগুলোতে এমন কোনো কমিটি নেই। তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এমন কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। সম্ভবত ম্যাডাম (সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা)থাকা অবস্থায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।’
ঘটনার আকষ্মিকতা বুঝে প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা কুলগাঁও সিটি করপোরেশন কলেজের অধ্যক্ষকে ফোন করে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি সম্পর্কে অবগত হন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নোটিশ ই-মেইলে পাঠাতে বলেন। বিষয়টিকে সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য তিনি আরও বলেন,আসলে এখানে একটু ঝামেলা আছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নোটিশ আমাদের কাছে আসে না।প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে চলে যায়। তারপরেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় আমাদের নজরে এলে আমরা প্রত্যেকটি বিষয় স্কুলে জানাই এবং সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।

অন্যদিকে স্কুল প্রধানরা বলছেন ভিন্ন কথা। কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকুমার দেবনাথ জানান,মাসখানেক আগেই আমরা পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করে থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে সবাইকে পাঠিয়েছি। এমনকী সিটি করপোরেশনেও পাঠিয়েছি। রমজানের জন্য স্কুল বন্ধ তাই স্কুল চালু হলেই কাজ শুরু করা হবে।
জামালখান কুসুম কুমারী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চম্পা মজুমদার বলেন, এইতো চলতি মাসের (মে) ৩-৪ তারিখে আমাদের কাছে মেইল এসেছে। ৬ তারিখ থেকে তো স্কুল বন্ধ তাই ৫ তারিখেই কমিটি করে থানা মাধ্যমিকে পাঠিয়ে দিয়েছি। স্কুল খুললেই কার্যক্রম শুরু হবে।

অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন,‘আমরা তো এসবের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আর যদি প্রবলেমও হয় তবে কাকে জানাবো? এখন আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। দেখলেন না ফেনীর নুসরাতের কি হাল হলো!’

প্রসঙ্গত, কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করা হয়।ওই রিটের শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি)ও বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন।ওই রিট নিষ্পত্তি করে ২০০৯ সালের ১৫ মে যৌন নিপীড়নের সংজ্ঞাসহ যৌন হয়রানি রোধে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়ে মামলাটির রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এই রায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানির বিষয়ে অভিযোগ কেন্দ্র গঠন এবং অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্যাতিত ও অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ না করার কথাও বলা হয়।

এর আগে গত ২৮ এপ্রিল দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে কমিটি গঠন করা হয়েছে কী না তা জানতে চেয়ে রিট আবেদন করা হয়েছে। এছাড়াও রিটে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

গত বছরে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠনের কথা জানে না। আদালতের নির্দেশনার কথা জানেন না ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা সচেতনতা দেখা গেলেও স্কুল বিশেষত মাদ্রাসা পর্যায়ের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক।মাধ্যমিকের বেশিরভাগ কর্তৃপক্ষই জানে না আদালতের নির্দেশনার কথা। যদিও গত এক দশকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই কার্যকর হয়নি এই নির্দেশনা।
আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটি করা হয়েছে সেগুলোও অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে। গত আট বছরে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনও তৈরি হয়নি।আবার যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আলাদা আইন প্রণয়নের দাবিও দেড় দশকে বাস্তবায়ন হয়নি।আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষাসহ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের উদাসীনতার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বাড়ছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ অভিভাবক।

এসআর /এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!