চট্টগ্রাম বিমানবন্দর/ সফটওয়্যারকে বোকা বানিয়ে ভুয়া কাগজে কার্গো পণ্য খালাস!

নেপথ্যে কাস্টমস ও সিএন্ডএফের সংঘবদ্ধ চক্র

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সফটওয়্যারকে বোকা বানিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে কার্গো পণ্য খালাসের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার সঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমসের এয়ারপোর্ট ও এয়ারফ্রেইট ইউনিটের কর্মকর্তা এবং কিছু সিএন্ডএফ এজেন্ট মালিকের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।

জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সম্প্রতি একটি সিএন্ডএফ এজেন্টের নয়টি বিল অব এন্ট্রি তদন্ত করা হয়। ওই তদন্তে দেখা যায়, সিএন্ডএফ এজেন্ট ওয়াটারওয়েজ শিপিং লিমিটেড জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব পরিশোধ ছাড়াই পণ্য খালাস করে নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এদিকে এই ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তথা সিভিল এভিয়েশন পরস্পরকে দোষারোপ করছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ টাকার বিনিময়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের কার্গো পণ্য খালাসে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। একটি সিএন্ডএফ এজেন্ট জালিয়াতির মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে পণ্য খালাস করেছে—এমন তথ্য চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজরে আসার পর বিষয়টি তদন্ত করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় কাস্টমসের এয়ারপোর্ট ও এয়ারফ্রেইট শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা মশিউর রহমানকে।

মশিউর রহমানের তদন্তের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের ডেপুটি কমিশনার নুরউদ্দিন মিলন চলতি বছরের ১২ মে তৎকালীন কমিশনার বরাবরে একটি প্রতিবেদন দেন। ওই প্রতিবেদনে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন তারিখে আনা নয়টি বিল অব এন্ট্রির তথ্য সবিস্তারে তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার নুরউদ্দিন মিলন উল্লেখ করেন, কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার সিস্টেম বিশ্লেষণ করে নয়টি বিল অব এন্ট্রির পণ্যে শুল্কায়ন সম্পন্ন হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতে প্রমাণিত হয় ওই চালানগুলোতে সিএন্ডএফ প্রতিনিধি ওয়াটারওয়েজ শিপিং লিমিটেড (সাবেক এমকোর্ড) পুরোপুরি জালিয়াতির মাধ্যমে প্রযোজ্য কর ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করে নিয়ে গেছে।

ওই প্রতিবেদনে নুরউদ্দিন মিলন আরও উল্লেখ করেন, জালিয়াতির মাধ্যমে কার্গো হল থেকে পণ্য ছাড় করায় ওই সিএন্ডএফ প্রতিনিধির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, জালিয়াতির মাধ্যমে কার্গো পণ্য খালাস করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কাস্টমসের এয়ারপোর্ট ও এয়ারফ্রেইট ইউনিটের কয়েকজন সদস্য জড়িত। যাকে দিয়ে প্রাথমিকভাবে ওই তদন্ত করা হয়েছে সেই রাজস্ব কর্মকর্তা মশিউর রহমানের দিকেও সন্দেহের তীর ছুঁড়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের একটি সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে প্রবাসীরা বাংলাদেশে আসার সময় নিত্যব্যবহার্য পণ্য আনার ক্ষেত্রে কার্গো সুবিধা গ্রহণ করে। এতে অপেক্ষাকৃত কম শুল্কে পণ্য নিয়ে আসার সুযোগ পায় প্রবাসীরা। এসব পণ্য ছাড় করতে সিএন্ডএফ এজেন্টদের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। সেই সুবিধার অপব্যবহার করে কাস্টমসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কার্গোর মাধ্যমে অবৈধভাবে পণ্য আমদানিতে সহায়তা দেয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মশিউর রহমান বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়াটারওয়েজ শিপিং লিমিটেডের নয়টি বিল অব এন্ট্রি পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায় অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার নেটওয়ার্ক ব্যবহার না করে ওই প্রতিষ্ঠান পণ্য খালাস করে নিয়ে গেছে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এত বড় জালিয়াতি কিভাবে সম্ভব হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এই জালিয়াতি করা সম্ভব।’ তবে তিনি জালিয়াতচক্রের সাথে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার নুরউদ্দিন মিলন বলেন, ‘এই জালিয়াতির সঙ্গে কেউ না কেউ জড়িত অবশ্যই আছে। এতে কাস্টমস কর্মকর্তা কিংবা সিভিল এভিয়েশনের যে কোন পর্যায়ের লোকও জড়িত থাকতে পারে।’

কাস্টমসের এয়ারপোর্ট ও এয়ারফ্রেইট শাখার কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোয় তদন্ত কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে বিষয়টি আরো খোলাসা হবে।’

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সরওয়ার ই জামান বলেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে কার্গো পণ্য খালাস করার একটি ঘটনা আমি শুনেছি। তবে কোনো সংস্থা থেকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত হইনি। এই ঘটনায় সিভিল এভিয়েশনের কোন গাফিলতি নেই। খালাসকৃত পণ্যের গুদাম ভাড়া কর্তৃপক্ষ পেয়েছে। জালিয়াতির ঘটনায় যদি কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকেন তাহলে সেটি তাদের বিষয়।’

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সদ্য সাবেক কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ওসব চালানে কী পণ্য এসেছে তা এখনো কাস্টমস হাউজ জানে না। বিষয়টি নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে। নতুন কমিশনার এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সদ্য যোগ দেওয়া কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম জানান, ‘আমি মাত্র (৯ জুন) যোগদান করেছি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবো।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!