রিভিউ খারিজ : মীর কাসেম আলীর ফাঁসি বহাল : কাল জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল

মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছে।  এতে একাত্তরের গুপ্তঘাতক কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির সাজাই বহাল রইল।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেমের করা আবেদন আজ মঙ্গলবার খারিজ করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

mir-kashem_30599

 

ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার অপরাধের জামায়াতে ইসলামীর অর্থ জোগানদাতার দণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা থাকল না।
নিয়ম অনুযায়ী একাত্তরের বদর নেতা কাসেম এখন কেবল নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এর নিষ্পত্তি হলেই সরকার দণ্ড কার্যকর করবে।
আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে মীর কাসেমের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে এ রায় দেন প্রধান  বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

রায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, রিভিউ আবেদনটি খারিজ করা হলো। রায় ঘোষণার সময় এজলাসকক্ষ ছিল পরিপূর্ণ। মীর কাসেমের রিভিউ আবেদনের ওপর গত রোববার শুনানি শেষ হয়। এরপর ৩০ আগস্ট (আজ) আদেশের তারিখ রাখেন আপিল বিভাগ।

 

রায় ঘোষণা উপলক্ষে আজ সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার দফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি শিগগিরই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস কাসেম রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ধূর্ততার স্বাক্ষর রেখে অত্যন্ত দ্রুততায় নিজের ও দলের উন্নতি ঘটান, পরিণত হন জামায়াতের আর্থিক মেরুদণ্ডে। তেষট্টি বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধী এখন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে।
কাসেম হলেন ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, শেষ বিচারেও যার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
গত ২৪ আগস্ট মামলাটির শুনানি শুরু হয়। ওই দিন মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের করা সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত রবিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি ঘোষণা করেন আদালত। এর আগে ২৫ জুলাই রিভিউ শুনানির জন্য এক মাস সময় দেয়া হয় মীর কাসেম আলীকে। তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ শুনানির জন্য ২ মাসের সময় আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এক মাসের সময় মঞ্জুর করে। তবে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সময় আবেদনের বিরোধিতা করেন।
গত ১৯ জুন আপিল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। এতে ১৪টি আইনি যুক্তি তুলে ধরে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার আবেদন জানানো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ৬ জুন প্রকাশ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোর জসিমসহ ৬ জনকে হত্যার দায়ে গত ৮ মার্চ মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন আদালত। পরে ৭ জুন তাকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।
মামলার সারসংক্ষেপ
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দুটিতে (১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ) মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া ৪টি অভিযোগে তাকে খালাস দেয়া হয়।

mir-kasem_30625

১১ নম্বর অভিযোগে রয়েছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ৬ জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি। এ অভিযোগে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ১২ নম্বর অভিযোগে রয়েছে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। এ অভিযোগে বিচারকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয়। ১১ ও ১২ নম্বর ছাড়া বাকি ১২টিই অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ মীর কাসেমের বিরুদ্ধে।
প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে ২ নম্বরটিতে মীর কাসেমকে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাকে ৭ বছর করে মোট ৪২ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই ৬টি অভিযোগে তাকে ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তবে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে এসব থেকে খালাস (অব্যাহতি) দেয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় মীর কাসেম আলীর পক্ষে আপিল করেন জয়নুল আবেদীন তুহিন। মীর কাসেমের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে এ আপিল করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে গত ৬ জানুয়ারি জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এ মামলা এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি আপিলের ষষ্ঠ রায়।
এ ছাড়া আপিলে চূড়ান্ত পাঁচটি রায়ের পর চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
আপিলের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। রায় রিভিউ চেয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ এরই মধ্যে আবেদন দাখিল করেছে।

কাল জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল

index

মানবতাবিরোধী অপরাধে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে কাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা এই কর্মসূচি চলবে।

আজ মঙ্গলবার মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করে দেওয়ার পর এক বিজ্ঞপ্তিতে কাল হরতাল দেওয়ার কথা জানিয়েছে দলটি। বিজ্ঞপ্তিতে দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সদস্য এম আলম স্বাক্ষর করেন।

 

বিবৃতিতে জানানো হয়, অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি, ফায়ার সার্ভিস, হজযাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি ও সংবাদপত্রের গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।

 

ঢাকা প্রতিদিন :::

এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!