বাঙালির বর্ষবরণ সংস্কৃতি

আশির দশকের শেষে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মুঠোফোন ছিল না। ছিল না ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। আজকের নববর্ষ অভিব্যক্তিতে অনেকটা জুড়ে আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম।

বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল ‘শুভ নববর্ষ’। নব্বইয়ের দশকের শুরুর পরপরই সেলফোন আসতে শুরু করে হাতের নাগালে। যদিও তখন ফেসবুক ছিল না। ফলে ফেসবুকের নীল দুনিয়ায় বর্ষবরণ বা বাঙালি হালচাল শুরু হয়নি। মুঠোফোনে বার্তা অপশনেই ছিল শুভেচ্ছার আদান-প্রদান।

‘শুভ নববর্ষ’ বাংলায় এ শুভেচ্ছা বাক্যের শুরুটা হয়েছিল রমনার বটমূলে, ছায়ানটের মঞ্চে, ভোরের রাগ, ভৈরবী, ললিত সুরের মূর্ছনায়। রমনার বটমূলে এসে পৃথিবীর কাছে মানুষ বুক ফুলিয়ে বলে, আমি বাঙালি ।কেমন ছিল বটমূলের আদ্যোপান্ত? জানতে কথা হয় ছায়ানটের সহ-সভাপতি ও সঙ্গীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলের সাথে ।

খায়রুল আনাম শাকিল
খায়রুল আনাম শাকিল
তিনি বলেন, বাষট্টি বছরের ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে প্রতিবাদ আর সম্ভাবনার আবহ ছড়িয়ে রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানে গানে বর্ষবরণের ভাবনা বিকাশ পেয়েছে পৃথিবীময়। এই রমনার বটমূলে যার শুরু ছিলো ১৯৬৭-তে। পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালন থেকে ছায়ানটের আজকের এই মিলনমেলা স্থিতি পেয়েছে বটমূলে। ইংরেজি ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। এছাড়াও ছায়ানট ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, শারদোৎসব ও বসন্তোৎসব গুরুত্বের সাথে পালন করে। ঐতিহ্যকে কখনো বদলানো যায় না। ছায়ানটের বর্ষবরণের ঐতিহ্যতেও আসবে না পরিবর্তন, এমনটাই মনে করেন সংগঠকরা। আর, সংস্কৃতির পরিবর্তন স্বাভাবিক, তবে এর মানে বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চা নয় বলে ভাবেন অনেকেই। যদিও ফিউশনের নামে ইংরেজি সুরে আছেন কেউ কেউ।

তিনি আরও বলেন, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরেরও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে।একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে প্রায় প্রতি জেলা সদরে এবং বেশ কিছু উপজেলা সদরে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হওয়ায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।

বর্ষবরণের আয়োজন কেবল রমনাতে সীমাবদ্ধ নয়। এ উৎসবকে ঘিরে নানান আয়োজন থাকে নগরীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনজুড়ে। পুরানো জঞ্জাল অবলীলায় ঝেড়ে ফেলে নতুনকে বরণ করতেই বর্ষবরণের আয়োজন করে থাকে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো । এ বিষয়ে কথা হয় প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসানের সাথে ।
তিনি জানান, বর্ষবরণের এ আড্ডায় বাঙালিয়ানা ঐতিহ্যকে সামনে রেখে কবিতা, গানের পরম্পরা সাজানো হয় ভোরের সুরের স্নিগ্ধতা থেকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথেই সে সুরে আসে ভিন্নতা। তবে প্রতি বছরেই ভিন্ন থিমে ব্যপ্তি মেলে আয়োজনের। এতে থাকে সামাজিক বিকাশের প্রকাশও। সমাজের অবক্ষয় দূর করতে নিজের সংস্কৃতি ধারন করার আহবান এই সংগঠকের। পান্তা আর ইলিশে যে সংস্কৃতির যোগাযোগ আছে এমনটা মনে করেন না তিনি।

রাশেদ হাসান আরও বলেন, বাঙালিয়ানার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানবতার প্রতীক হতে চায় প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। শুদ্ধ উচ্চারণ, আবৃত্তি, সংস্কৃতি চর্চায় অনন্য দৃষ্টান্ত এ সাংস্কৃতিক সংগঠনের।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় সর্বত্র স্বীকৃত বর্ষপঞ্জি হলো গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি, পাশ্চাত্য বর্ষপঞ্জি, ইংরেজি বর্ষপঞ্জি বা খ্রিস্টাব্দ। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশের প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!