বাঁশখালীতে দুই শতাধিক ফিশিংবোট থেকে মাসে ৬০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি!

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল বাংলাবাজার এলাকায় জলকদর খালের ওপর একসময় ব্রিজ ছিল না। ওই সময় গণ্ডামারা ইউনিয়ন ও চাম্বল ইউনিয়নের বাসিন্দারা নৌকা কিংবা ফেরি নিয়ে পারাপার করতো। তাই জেলা পরিষদ থেকে এ ঘাটটি প্রতিবছর ইজারা দেওয়া হতো। ১৯৯৭ সালে ওই জলকদর খালের ওপর বিশাল ব্রিজ নির্মাণ হয়। এরপর থেকে যাবতীয় যানবাহন ও মানুষ পারাপার হয়ে থাকে ওই ব্রিজের ওপর দিয়ে। কিন্তু ব্রিজ নির্মাণের গত ২২ বছর পার হলেও ঘাটটিতে এখনও একইভাবে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। ফলে ফেরি না থাকলেও ফেরিঘাটের নামে ইজারা নিয়ে ফিশিং বোটের দুই শতাধিক মালিকের কাছ থেকে প্রকাশ্যে চলছে চাঁদাবাজি।

চাঁদা না দিলে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার থেকে আসা নীরিহ জেলেদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। চাঁদার টাকায় স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ থাকায় নির্যাতনের শিকার ভিন্ন উপজেলার জেলেরা অভিযোগই করতে পারেন না। ফলে প্রতিদিনের বহুমুখী নির্যাতনের চিত্র নীরবেই সহ্য করতে হচ্ছে কয়েকশত জেলেদের।

সরেজমিনে ঘুরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী জেলে ও ফিশিং বোটের মালিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, ইজারা নিয়ে ইজারাদার নিয়ম বহির্ভুতভাবে দুই শতাধিক ফিশিং বোটের মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে চলছে। ইজারায় ফিশিং বোট থেকে একটাকাও নেওয়ার নিয়ম না থাকলেও স্থানীয় আহমদ কবিরের ছেলে মো. মোস্তাক প্রতিদিনই লাঠিসোঠা নিয়ে ৪০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জোরপূর্বক আদায় করছে। এর পেছনে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বঘোষিত বোট মালিক সমিতির সভাপতি হেফাজুল ইসলাম।

ঘাটটি মাহমুদুল ইসলাম নামের জনৈক ব্যক্তি ১০ লাখ ১০ হাজার ২১০ টাকায় ইজারা পেয়েছেন। ওই ইজারাদারের কাছ থেকে সাব ঠিকাদারি নিয়েছেন ১৪ লাখ টাকায় বোট মালিক সমিতির নামে কিছু ব্যক্তি। সাব ঠিকাদারি নেওয়া হলেও নিয়ম বহির্ভূত অসংখ্য জেলেদের কাছ থেকে এককালীন ১৫ হাজার টাকা আদায় এবং ঘাটে মাছ নামাতে দৈনিক ৫০০/৬০০ টাকা আদায়ের কারণে দৈনিক দেড় লাখ/দুই লাখ টাকা আদায় হয়ে থাকে। ফলে মাসে ৬০ লাখ আদায় হওয়ায় এ ঘাটটিতে দখল-বেদখল নিয়ে প্রায়শঃ ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকে।

ফিশিং বোটের মালিকরা টাকা না দিলে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে ফিশিং বোটের মাছ ও ইঞ্জিন লুটপাট করা হয়। চুক্তি মোতাবেক ১৩টি শর্ত অনুসারে জেলা পরিষদ থেকে ইজারা দিলেও ইজারাদার একটি শর্তও পালন করছে না। এমনকি ওইসব শর্ত পালনের পরিস্থিতিও নেই ওই ফেরিঘাটে।

ইজারা চুক্তির ৬ নম্বর শর্ত অনুসারে ওই ঘাটে ইজারাদারের মালিকাধীন ৮টি নৌযান রাখার নিয়ম থাকলেও ইজারাদারের একটি নৌযানও নেই। যত নৌযান আছে সব ফিশিং বোটের মালিকদের। কোথাও ইজারার শর্ত মোতাবেক সাইনবোর্ডও নেই।

জেলা পরিষদ থেকে প্রাপ্ত ইজারা চুক্তি অনুসারে দেখা গেছে, যাত্রী পারাপার মাথাপিছু ৩ টাকা, সাইকেল পারাপার ৩ টাকা, গরু মহিষ, ছাগল ৭ টাকা, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী প্রতি কেজি ১ টাকা, আসবাবপত্র প্রতিটি ৪ টাকা, কাঠ প্রতি বর্গফুট ২ টাকা, বালু প্রতি বর্গফুট ১ টাকা, ইট প্রতি হাজার ২০০ টাকা, সিমেন্ট প্রতি বস্তা ৫ টাকা, রড প্রতি টন ৫০০ টাকা। ফিশিং বোটের কোনো টাকার কথা উল্লেখ নেই।

বাংলাবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির স্বঘোষিত সভাপতি ও ফেরিঘাটের সাব ইজারাদার হেফাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকৃত ইজারাদারদের কাছ থেকে আমরা বোট মালিকরা সাব ইজারা নিয়েছি। এখানে সমিতির অন্তর্ভুক্ত ফিশিং বোটের মালিক ১২৫ জন। অন্যান্য এলাকা থেকে আরও শতাধিক ফিশিং বোট এ ঘাটে মাছ নামায়। আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত ১২৫ ফিশিং বোট থেকে এককালীন ১৫ হাজার টাকা নিয়েছি। ওই টাকা নিয়ে ইজারার টাকা দিয়েছি। যারা সমিতির বাইরে তাদের কাছ থেকে কিছু ঘাট খরচ নেওয়া হয়। এখানে কোন চাঁদাবাজি হয় না।’

চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাবাজার ফেরিঘাটে চাঁদাবাজি হয় তা আমি জানি না। কেউ অভিযোগও করেননি।’

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার বলেন, ‘বাংলাবাজার ফেরিঘাটে চাঁদাবাজি হয় এমন অভিযোগ কেউ করেননি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইজারার বিষয়টিও দেখা হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ‘বাংলাবাজার ফেরিঘাটটি দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ইজারা হয়ে আসছে। ফিশিং বোট মালিকদের অভিযোগ আমিও পেয়েছি। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্র বন্ধ হওয়ার পিছনে যৌক্তিতা প্রয়োজন। যা তদন্ত সাপেক্ষ বিষয়।’

এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!