৮ বছরে ১৯ হাতির মৃত্যু বাঁশখালীতে, বনের দায়সারা তদন্তে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা

মৃত হাতির নমুনা ছয়দিনেও পাঠানো হয়নি পরীক্ষাগারে

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে থামছে না হাতি হত্যা। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে হাতি মেরে মাটিচাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত আট বছরে উপজেলার বনাঞ্চলে মারা গেছে ১৯টি হাতি। তবে এসব বিষয়ে তেমন নজর নেয় বনবিভাগের। দায়সারা তদন্ত রিপোর্ট এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় হাতি হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে প্রায় সময়। মূলত খাদ্য সংকট ও পাহাড় উজাড়ের কারণে লোকালয়ে নেমে আসে হাতির পাল। আর লোকালয়ে এসেই মানুষের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে এসব বন্য প্রাণী।

সর্বশেষ বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য জঙ্গল পুঁইছড়ি পাহাড়ে একটি হাতি মেরে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। এ ঘটনা বনবিভাগ জানতে পারে ১১ দিন পর। এরপর ‘দায়সারা’ ময়নাতদন্ত শেষে থানায় জিডি করে। তবে এ ঘটনা স্থানীয় সাংবাদিকরা জানতে পারেন আরও ছয়দিন পর সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর)। তবে যারা হাতি মেরেছে তারা সেটি মাটিচাপা দিয়ে গা-ঢাকা দেয়। এদিকে বনবিভাগ জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার আগে কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

এর আগে গত ১১ জুন কালীপুর ইউনিয়নের জঙ্গল কালীপুরে গভীর জঙ্গলে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মারা হয় একটি হাতি। এর আগেও জঙ্গল কালীপুরে মৃত হাতির শাবক পাওয়া গেছে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর বাঁশখালী সাধনপুর ইউনিয়নে লটমনি পাহাড়ে একটি হাতিকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয় দুষ্কৃতিকারীরা এবং ১২ নভেম্বর বাঁশখালীর চাম্বল বনবিট অফিসের অদূরে আরও ১টি হাতি মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত আট বছরে বাঁশখালীর বনাঞ্চলে মারা গেছে ১৯টি হাতি। শুধুমাত্র কালীপুর রেঞ্জে মারা গেছে ১২টি বন্য হাতি, জলদী ও পুঁইছড়ি রেঞ্জে ৭টি। তবে অসুস্থ ৩টি হাতিকে সুস্থ করে বনাঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পুঁইছড়ি ইউনিয়নের জঙ্গল পুঁইছড়ি বান্দরমরা পাহাড় ও জমি ঘুরে দেখা গেছে, ১৭ দিন আগে হাতিটি মেরে যেখানে দুষ্কৃতিকারীরা মেরে মাটিচাপা দিয়েছিল সেখানেই ময়নাতদন্ত শেষে বনবিভাগ ও উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তারা আবারও হাতিটি মাটিচাপা দেয়।

স্থানীয় কৃষক আলী নবী, নেছার আহমেদসহ অনেকে বলেন, হাতিটি অনেকদিন আগে কে বা কারা মেরে বান্দরমরা পাহাড়ের সমতল অংশে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষের কাছ থেকে খবর পেয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর বনবিভাগ ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তারা এসে হাতিটি মাটি থেকে ওঠান। পরে ময়নাতদন্ত করে আবার ওই স্থানে মাটিচাপা দেওয়া হয় এবং গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।

তারা আরও বলেন, ওই পাহাড় এবং ধানী জমির মৌরশী সূত্রে মালিক ফরহাদ মিয়া, ফারুক সিকদার, হানে আলম ও মঞ্জুর মিয়া। ওরা বিশাল ওই পাহাড়ি সম্পত্তি স্থানীয় কৃষক জাহাঙ্গীর, দেলোয়ার, আজিমকে বর্গা হিসেবে দিয়েছেন।

অভিযোগ ওঠেছে, জমির মালিক ফারুক সিকদার ও ফরহাদ মিয়া হাতি মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে বনবিভাগ ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করছে। এ কারণে গত ২০ সেপ্টেম্বর ময়নাতদন্ত করা হলেও বাঁশখালী উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর থেকে সোমবার পর্যন্ত নমুনা কুমিল্লা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়নি।

এদিকে বড় হাতিটিকে ‘হাতির বাচ্চা’ উল্লেখ করে বনবিভাগ থানায় জিডি করেছে। এমনকি ময়নাতদন্ত করা এবং হাতিটি মেরে পুঁতে রাখা জায়গার মালিক কারা, তাও উল্লেখ করা হয়নি।

বাঁশখালী উপজেলা প্রাণীসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ডা. মো. তানভীর হোসেন বলেন, ‘ময়নাতদন্তের সময় হাতিটির পঁচা গন্ধ ছড়িয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ময়নাতদন্তের দিনের অন্তত ১১-১২ দিন আগে হাতিটি মারা যায়। প্রাথমিক ধারণা, কেউ মেরে হাতিটিকে মাটিতে পুঁতে দেয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পর বোঝা যাবে হাতিটি কিভাবে মরেছে। ময়নাতদন্তের সুরতহাল এখনও কুমিল্লায় পাঠানো হয়নি।’

পুঁইছড়ি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য বিট কর্মকর্তা মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘থানায় জিডি করার পর হাতিটি কিভাবে মারা গেছে, তা তদন্ত করছি।’

জিডিতে হাতি মেরে মাটিতে পুঁতে রাখার বিষয় এবং হাতি মারার স্থানের মালিকদের নাম নেই কেন—জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর তিনি দেননি। তবে তিনি নানামুখি ভয়ে আছেন এবং কিছুদিন আগে স্থানীয় এক দস্যু তাকে ছুরি দিয়ে মেরেছেন বলে জানান।

পুঁইছড়ি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিছুজ্জামান শেখ বলেন, ‘হাতি মৃত্যুর ঘটনাটি জোরালোভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। হাতিটি যদি কেউ হত্যা করে থাকে তাহলে তাকে রেহাই দেওয়া হবে না।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!