৮১ কোটি টাকা মেরে বাড়ি-ফ্ল্যাট ও ব্যবসা গড়েছেন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের পরিচালক

টাকা হাতানোয় সহযোগী জিএম মারা গেছেন করোনায়

চট্টগ্রামভিত্তিক সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেড থেকে ৮১ কোটি টাকারও বেশি মেরে দিয়েছেন কোম্পানিটির বেসরকারি পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ। আর এই টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় সহায়তা দিয়ে আরও ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ শাহেদ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ১৮ আগস্ট মারা যান তিনি।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেড। লুব অয়েলের ব্যবসা পরিচালনা করা কোম্পানিটি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিকের কারখানা। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানার এই প্রতিষ্ঠানে বিপিসির মালিকানায় আছে ৫০ শতাংশ শেয়ার। বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মঈন উদ্দিন আহমেদ ও তার ভাই মিশু মিনহাজ।

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানিতে কথিত ‘লোকসান’ দেখিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তদন্ত শুরু করে বিপিসি। ওই বছরের মার্চে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে দুদকের উপ-পরিচালক তালেবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন টিমকে দায়িত্ব দেয় কমিশন। বিপিসির অনুসন্ধানে দুই অর্থবছরে হিসেবে ১৩৮ কোটি টাকা তছরুপের গরমিলের নথিপত্র নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে রীতিমতো বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়।

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি চলে একটি পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। সরকার ও কোম্পানির পক্ষ থেকে যৌথভাবে শীর্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মোহাম্মদ শাহেদকে। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মঈন উদ্দিন আহমেদ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মোহাম্মদ সাহেদ এবং মঈন উদ্দিন মিলে কোস্পানির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করেন যৌথভাবে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে দেখেছে, এই মঈন উদ্দিন ৮১ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছেন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেড থেকে। এই টাকায় তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনটি। বাকি টাকা বাড়ি নির্মাণসহ বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন খাতে।

২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ও সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারিতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার সুপারিশ করা হয়। অন্যদিকে মোহাম্মদ শাহেদ করোনায় মারা যাওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এদিকে ৮১ কোটিরও বেশি টাকা ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ছাড়াও চট্টগ্রামভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে নতুন নতুন দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে আসছে। বেসরকারি পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদের কাছে কোম্পানিটির অনেক পাওনাও অনাদায়ী রয়ে গেছে।

দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সময়ে ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব থেকে মঈন উদ্দিন প্রায় ৪২ কোটি টাকা তুলে নিজের প্রতিষ্ঠান পিরামিড এক্সিম লিমিটেডের চারটি ব্যাংক একাউন্টে জমা করেন।

এছাড়া ট্যাংকার ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের বিপরীতে তিনি ইচ্ছামাফিক রিকুইজিশন দিতেন। যে নগদ চেকের মাধ্যমে তিনি এই টাকা হাতিয়েছেন, সেগুলোর বেশিরভাগেই ছিল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের স্বাক্ষর। এর ‘পুরস্কার’ হিসেবে শাহেদ হাতিয়েছেন ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

দুদকের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মঈন উদ্দিন আহমেদের ব্যাংক একাউন্টে ঢোকা টাকা থেকে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা দিয়ে তিনি তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ঢাকার লালমাটিয়ায় বাড়ি নির্মাণের জন্য ভূমি ডেভেলপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ছয় কোটি টাকা। এছাড়া একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা ও ব্র্যান্ডস অনলি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় দেড় কোটি টাকা দিয়েছেন।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঈন উদ্দিন আহমেদ খরচের নাম করে নিজের নামে বা অন্য কর্মচারীদের নামে চেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। এই টাকার পুরোটাই তিনি একাই মেরে দিয়েছেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির ব্যাংক একাউন্টে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে জমা করেন। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে ওই টাকা জমা হয়। গুডউইন পাওয়ারের অন্যতম অংশীদার শাহেদ নিজেই। এটি চাকরির শৃঙ্খলারও পরিপন্থী বলেও দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যাওয়ায় মামলায় তাকে রাখার সুযোগ নেই বলে দুদক জানিয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!