৭ বছর পর শাহাদাতের পকেটছাড়া হচ্ছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদল

চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলকে নিজের পকেটে রাখার সর্বশেষ ফন্দিও ব্যর্থ হচ্ছে নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনের। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরে কমিটি গঠনের আবদার করেছেন ডা. শাহাদাত। তবে তা আমলে নিচ্ছেন না ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তারেক রহমান সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ছাত্রদলের কমিটি গঠন করবে ছাত্রদল এবং এক্ষেত্রে অন্য কিছু ভাববার সুযোগ নেই। আহবায়ক কমিটি অবশ্যই জুলাইয়ের মধ্যে ঘোষণা দিতে হবে।

তারেক রহমানের এই নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঠিক সাত বছরের মাথায় এসে ডা. শাহাদাত হোসেনের পকেট সংগঠন হিসেবে আর থাকছে না নগর ছাত্রদল। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, ছাত্রদলের নেতৃত্বে ফিরবেন ছাত্ররা।

জুলাইয়ের মধ্যেই নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের নির্দেশ পাওয়ার বিষয়টি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের জ্যেষ্ঠ সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ।

তিনি বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাংগঠনিক অভিভাবক দুই জন। একজন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, অপরজন জননেতা তারেক রহমান। লন্ডন থেকে তারেক রহমান আমাদের কাজকর্ম তত্ত্বাবধান করছেন। তাঁর নির্দেশেই আমরা চট্টগ্রাম নগর, উত্তর জেলা, দক্ষিণ জেলা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটি গঠনে কাজ করছি। সবগুলো কমিটিই পূর্ণাঙ্গ হবে। ৩১ জুলাইয়ের আগেই নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটির আকার হবে ৩১ সদস্যের, যদি যোগ্য নেতা বেশী পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে কমিটির সদস্য আরও বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, নগর ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশীদের বয়সসীমা ২০০০ সালের এসএসসি হিসেবে করেই পদ দেওয়া হচ্ছে। ২০০০ সালের পর এসএসসি পাস করা নেতাদের বিবাহিতরা মূল পদে আসছেন না। বিবাহিতদেরকে ছাত্রদলের কোন পদে না এনে তাদেরকে যুবদল বা স্বেচ্ছাসেবক দলে পদায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন তারেক রহমান।

আজ থেকে ঠিক ৭ বছর আগে ২১ জুলাই ২০১৩ সালে প্রায় ৫০ বছরের কাছাকাছি বয়স্ক অছাত্র, একাধিক সন্তানের পিতা গাজী সিরাজ উল্লাহকে সভাপতি এবং বেলায়েত হোসেন বুলুকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্যের নগর কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই ১১ জন থেকে একজন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ১০ জনের কমিটিই পার করলো সাত বছর।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহ মূলত নগর রাজনীতি কিংবা কোনো ক্যাম্পাস থেকে বেড়ে না ওঠায় নগর ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ পদের ভার তার জন্য অনেক বেশি হয়ে যায়। তার এই দুর্বলতার সুযোগ নেন নগর বিএনপির সভাপতি হওয়া ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি নিজের তিন বছর মেয়াদে যেমন নগর বিএনপির একটার বেশি দুই থানার পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি তেমনি নগর ছাত্রদলকেও কার্যত ব্যর্থ সংগঠনে পরিণত করেছেন— এমন অভিযোগ অনেকের।

নগর ছাত্রদলের সাবেক নেতারা জানান, গাজী সিরাজ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ছাত্রদল পুরোপুরি ডা. শাহাদাত হোসেনের ক্লিনিক আর বাসার সংগঠনে পরিণত হয়। নগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক অদক্ষতায় দেশের অন্যতম প্রধান এই ছাত্র সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী আজ দলীয় পদ-পদবিহীন। ওয়ার্ড, থানা এবং প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে নগর কমিটিতে আসার মতো কোনো নেতা ছাত্রদলে নেই। এবার যারা পদে আসবেন তাদের কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই ‘ভাই’য়ের অনুসারী পরিচয়েই নেতৃত্বে আসবেন। বিভিন্ন ভাইয়ের পরিচয়ে দেওয়া সাড়ে তিনশ নেতাকর্মী নগর কমিটিতে আসতে চান।

নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগর কমিটিতে স্থান পেতে বিভিন্ন নেতার অনুসারী ৩৪৯ জন নেতাকর্মীর তালিকা তাদের হাতে এসেছে। তালিকাটি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদে পাঠানো হয়েছে।’ তার দাবি অনুযায়ী ওই তালিকায় সর্বোচ্চ সংখ্যক অনুসারী সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমানের। তার অনুসারী ৮২ জন। আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর অনুসারী ৭০ জন এবং ডা. শাহাদাতের অনুসারী ৫৫ জন।

তবে ছাত্রদলের আরেক নেতা জানান, তালিকায় ডা. শাহাদাতের অনুসারীদের নামই সবচেয়ে বেশি। গাজী সিরাজ, জিয়াউর রহমান, জমির উদ্দিনসহ নগর ছাত্রদলের নেতাদের মাধ্যমে ডা. শাহাদাত দেড়শতাধিক নেতাকর্মীর তালিকা জমা দিয়েছেন। নগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আবু সুফিয়ানের পক্ষ থেকে এসেছে ১৭ জনের সুপারিশ, আবুল হাশেম বক্করের তালিকাও ছোট।

নেতৃত্বশূন্যতায় অস্তিত্ব সংকটে থাকা ছাত্রদলের নগর আহ্বায়ক কমিটিতে কারা আসছেন জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বিগত দিনে আন্দোলন সংগ্রামে তাদের ভূমিকাই মূখ্য বিষয়। কোনো ভাইয়ের অনুসারী হিসেবে কাউকে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।

তালিকা দীর্ঘ হলেও ৩১ সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুসারীরা পাচ্ছেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। কারণ সাড়ে ৩০০ আবেদনকারীর মধ্যে ৫২ জন রয়েছেন বিবাহিত। যাদের অধিকাংশই ডা. শাহাদাতের অনুসারী। ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি সাংগঠনিক ইউনিটগুলো গোছাতে না পারায় এখনও ছাত্রদল বলতে যা বোঝায় তা মোশারফ হোসেন দীপ্তি আর আহমদুল আলম চৌধুরী রাসেলের হাতে গড়া। শক্তিশালী কোন ইউনিট বা থানা কমিটি না থাকায় তারা এলাকাভিত্তিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন।

জানা গেছে, এই দুই পদের জন্য শর্টলিস্ট তৈরি করে লন্ডনে প্রস্তাবনা পাঠানো হচ্ছে। সেই তালিকায় শরীফুল ইসলাম তুহিন, সাইফুল আলম, মহসিন কবির আপেল, আরিফুর রহমান, রাজিবুল হক বাপ্পি, সামিয়াত আমিন জিসান, শরীফুজ্জামান ও তানভীরের নাম রয়েছে। এদের থেকেই আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব ঘোষণা করা হবে এবং অন্যরা কমিটিতে থাকবেন।

তবে বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন চৌধুরী ছাড়া বাকিরা সবাই যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও বিএনপির বিভিন্ন পদে আছেন। জসিম উদ্দিন চৌধুরীও বয়সে গাজী সিরাজের কাছাকাছি। অভিযোগ উঠছে ডা. শাহাদাত হোসেন জসিম চৌধুরীকে আহ্বায়ক করতে চান। যাতে বিবাহিতদের একটা সুরাহা হয়। কিন্তু এই আবদারও নাকচ করলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতারা।

যুবদল এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের নগর কমিটিতে ডা. শাহাদাতের কোন প্রভাব না থাকায় এই দুটি সংগঠন নির্দিষ্ট সময়ে পূর্ণাঙ্গ নগর কমিটি গঠন করে কোন ঝামেলা ছাড়াই কেন্দ্রে জমা দিতে পেরেছে। যার কারণে ছাত্রদল নিয়ে তারেক রহমান এবং তার নির্দেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ ডা. শাহাদাতের পকেট থেকে ছাত্রদলকে মুক্ত করতে চলতি মাসেই নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করছে। সেই কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবে।

এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!