৭ দশকে বন্ধ ২০ ট্যানারি, ঢাকায় জিম্মি চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসা

চট্টগ্রামে গত সাত দশকে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান। চালু আছে মাত্র একটি। অনভিজ্ঞতা, অব্যবস্থাপনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ। উপায় না পেয়ে ব্যবসায়ীরা সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ চামড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি প্রতিষ্ঠান না থাকায় আসন্ন কোরবানির ঈদে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা করছেন এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীরা।

ট্যানারির অভাবে ব্যবসায় ধস নামায় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা ঢাকামুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে চামড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ায় পারিবারিকভাবে পাওয়া এ খাতের ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় ট্যানারি শিল্প ও চামড়া ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা। পাশাপাশি কমাতে হবে বন্দর, বন্ড ও কাস্টমের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে ট্যানারিভিত্তিক জোন। আমদানি-রপ্তানিতে কমাতে হবে প্রতিবন্ধকতা। বাড়াতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতাও।

জানা যায়, চট্টগ্রামে চামড়া শিল্পের শুরু ১৯৪৮ সালে। লাভজনক থাকায় কালুরঘাট শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে এখানে গড়ে ওঠে ১৬টি ট্যানারি। স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠে আরও পাঁচটি। কিন্তু অনভিজ্ঞতা, পরিবেশ আইন না মানা, অব্যবস্থাপনা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্রমাগত বন্ধ হতে থাকে এসব ট্যানারি। ইটিপি না থাকায় কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে মদিনা ট্যানারি। চালু আছে সবেধন নীলমনি রিফ রেদার লিমিটেড।

মদিনা ও রিফ লেদার ট্যানারি ছাড়া স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ট্যানারিগুলো হলো তিতাস, রওশন, কর্ণফুলী, মন্টি, জামান রহমান, এইচআরসি, ওরিয়েন্ট, মেঘনা, ডোরা, সিকো লেদার, জুবিলী ট্যানারি, খাজা, এশিয়া, মেট্রোপলিটন, চিটাগাং ট্যানারি।

চামড়ার তৈরি জুতা, জ্যাকেট, লংবুট আভিজাত্যের প্রতীক। এখন এসবের ব্যবহার কমে গেছে। এখন ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষ সিনথেটিক জুতা ব্যবহার করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঠাণ্ডা কমে যাওয়ায় জ্যাকেট ও লংবুটের ব্যবহারও কমে গেছে। এর ফলে চামড়ার ব্যবহার কমে গেছে। চামড়া ব্যবসায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। চামড়ার ব্যবহার কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার ব্যবসায়ে মন্দাভাব। এদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে মাংস খাওয়া বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে চামড়ার সরবরাহ বেড়ে গেছে, কিন্তু ব্যবহার বাড়েনি।

চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে চামড়া ব্যবসার সঙ্গে চট্টগ্রামে ২০ থেকে ৩০ হাজার লোক জড়িত। বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়। এছাড়া কোরবানির সময় বিক্রি হয় ৬ লাখ চামড়া। প্রতি বছর কোরবানি ঈদে তিন থেকে সাড়ে চার লাখ পিস গরুর চামড়া, এক থেকে এক লাখ ২০ হাজার পিস ছাগলের চামড়া, ১০ থেকে ১৫ হাজার পিস মহিষের চামড়া ও ১০ হাজার পিস ভেড়ার চামড়া। সংগ্রহের পর এসব চামড়ার বাজারমূল্য ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে চামড়া শিল্পের প্রচুর কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ট্যানারি শিল্প না থাকায় ঢাকার ট্যানারি মালিকদের ওপর নির্ভর করতে হয় চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের।

চট্টগ্রামে গত বছর কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করা ৬ লাখ চামড়ার মধ্যে ৪ লাখ চামড়া চলে যায় ঢাকার ট্যানারিগুলোতে। এছাড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের শর্ত মেনে অধিকাংশ চামড়াই বাকিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা। ঢাকার ট্যানারিগুলো থেকে গত বছরের চামড়া বিক্রির টাকা এখনও না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের।

কোরবানির দিন সাধারণত স্থানীয় উদ্যোক্তারা মাঠ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে থাকে। ব্যাপারি ও আড়তদারের হাতবদল হয়ে এ সব চামড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে আসে। চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির অধীনে ১৭০ জন এবং এর বাইরে আরো ৫০ থেকে ৬০ জন চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে।

জানা যায়, প্রতি বছর কোরবানির ঈদে রিফ লেদার লিমিটেড ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার পিস চামড়া ক্রয় করে থাকে। মদিনা ট্যানারি চালু থাকাকালীন তারা ২০ শতাংশ চামড়া ক্রয় করতো। বাকি চামড়াগুলো কোরবানির ১০-১৫ দিন পর ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা কিনে নিয়ে যান।

চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে বিক্রি করা অর্থের প্রায় ২০-২৫ কোটি টাকা এখনো অনাদায়ী রয়ে গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, ‘কাস্টম, বন্ড ও বন্দরে প্রচুর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিয়ম। সিঙ্গাপুরে জাহাজ এসে আটকে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দরে জায়গা নেই। এর ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসছে না।

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘রিফ লেদার ও মদিনা ট্যানারির কাছে চামড়া বিক্রি করলে নগদ টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করলে টাকা বাকি থেকে যায়। টাকা পেতে পেতে আরেক কোরবান এসে যায়। কয়েক বছর ধরে কোরবানে লোকসান দিতে দিতে পুঁজি হারিয়েছি আমরা। কোরবানে আমরা ধার করে টাকা নিয়ে ও বাকিতে চামড়া ক্রয় করে থাকি। ঢাকার ট্যানারি মালিকেরা নগদ টাকা দিয়ে দিলে আমরা উপকৃত হতে পারতাম। ধার করা টাকা শোধ করতে পারতাম।’

তিনি বলেন, ‘অনভিজ্ঞতা ও লোকসান দিতে দিতে ২০টি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ট্যানারিগুলো থাকলে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা ঢাকামুখী হতো না। চামড়া শিল্পকে রক্ষা করতে হলে ট্যানারি মালিকদের মতো চামড়ার আতড়দারদেরকেও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে।’

চট্টগ্রামে একমাত্র রিফ লেদার লিমিটেডের ইটিপি আছে। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৬০-৭০ হাজার পিস চামড়া কিনেছিল। এছাড়া সারা বছরই প্রতিষ্ঠানটি চামড়া কিনে থাকে। এর ফলে এ বছর কোরবানির কী পরিমাণ চামড়া কিনবে তা নির্ধারণ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর রিফ লেদার কোরবানির চামড়া না কেনার সম্ভাবনাই বেশি। তাই চামড়ার আড়তদারেরা শঙ্কায় আছেন।

রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড সেলস) মো. মোকলেছুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বছর কোরবানিতে কী পরিমাণ চামড়া ক্রয় করবো তা এখনও ঠিক করিনি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে জুতা, ব্যাগ ফ্যাক্টরি গড়ে তুলতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড এমনকি মিয়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে। সরকার চাইলে পরিবর্তন সম্ভব। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। পুরো চামড়া সেক্টরকে বাঁচাতে হলে ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। চামড়ার মতো জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করতে হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!