৬ লোক মারা গেলেই চট্টগ্রামের এক ভাষা হারিয়ে যাবে চিরতরে, চারজনই ষাটোর্ধ

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে এখনও পর্যন্ত টিকে থাকা ‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র ৬ জন মানুষ। চল্লিশের দশকেও বান্দরবানের মুরুং জনগোষ্ঠীর ছয়-সাত হাজার মানুষ এই ভাষায় কথা বলতেন। বছরের পর বছর সেই সংখ্যা কমতে কমতে এখন এসে ঠেকেছে মাত্র ৬ জনে।

‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারা কয়েকজনকে নিয়ে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন।
‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারা কয়েকজনকে নিয়ে ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন।

এই ছয়জন লোক মারা গেলে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা। ‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় এখনও পর্যন্ত কথা বলতে পারা এক নারী ও পাঁচ পুরুষের মধ্যে চারজনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। বাকি দুজনের একজনের বয়স ৫৮ বছর ও অপরজনের ৪৫।

বান্দরবানের আলিকদম প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদের দেওয়া সবশেষ তথ্য অনুসারে, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় বর্তমানে রেংপুং হেডম্যান পাড়া ও ক্রাঞ্চি পাড়ায় ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা জানা মুরুং রয়েছেন মাত্র চারজন। পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ওয়াইবট পাড়া ও কাইনওয়াই পাড়ায় রয়েছেন আরও দুজন।

গত শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বান্দরবানে বিলুপ্তির পথে থাকা ম্রো ভাষা ও বর্ণমালায় রচিত পাঁচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা রক্ষার দাবি জানানো হয়। ওই অনুষ্ঠানে রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারা ম্র্রো ও সিংরা ম্রো নামে দুই ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, বর্তমানে এই রেংমিটচ্য ভাষা বেঁচে আছে শুধু ১০ জনের মুখে মুখে। তারা মারা গেলে এই ভাষাও পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসনের উদ্যোগে বান্দরবানে আয়োজন করা হয়েছিল ‘রেংমিটচ্য’ ভাষারক্ষার কর্মশালা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসনের উদ্যোগে বান্দরবানে আয়োজন করা হয়েছিল ‘রেংমিটচ্য’ ভাষারক্ষার কর্মশালা।

ষাটের দশকে বান্দরবানে রেংমিটচ্য ভাষাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার। পরে বিপন্ন ভাষা নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে অনুসন্ধান চালান যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড এ পিটারসন। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওই ভাষাবিজ্ঞানী ‘রেংমিটচ্য’ ভাষাভাষীর খোঁজ পান বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৈনফা মৌজায়। ওই সময় তিনি ‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারা ১২ জনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রেকর্ড করেন। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি তিনি বান্দরবান প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সেই গবেষণা থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

ডেভিড এ পিটারসন তখন সাংবাদিকদের জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডকুমেন্টিং অ্যানডেইঞ্জার্ড ল্যাগুয়েজেস গ্রোগ্রাম ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারকৃত রেংমিটচ্য ভাষা সংরক্ষণকে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারেন যে ৬ জন মানুষ, তাদের একজন আলীকদম উপজেলার ২৯১নং তৈনফা মৌজার হেডম্যান ৭০ বছর বয়সী রেংপুং ম্রো। বাকি যারা এই ভাষা পুরোপুরি জানেন, তাদের বয়সও ষাটের ওপরে। তাদের বসবাস মূলত তৈনখাল এলাকার ক্রাংচিপাড়া, পায়া কার্বারিপাড়া ও টিংকু পাড়ায়।

স্থানীয় সাংবাদিকদের রেংপুং ম্রো জানান, ‘একযুগ আগে একজন ব্রিটিশ গবেষক আলীকদমের তৈনখাল এলাকা ঘুরে রেংমিটচ্য ভাষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে তিনি বান্দরবান প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সেই গবেষণা থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।’

হেডম্যান রেংপুং বলেন, ‘রেংমিটচ্য ভাষাভাষী লোকজন এতই কম যে, ইচ্ছে করলেও তিনি কিংবা অন্য যারা এ ভাষা জানেন তারা কথা বলতে পারেন না। এ ভাষা জানা লোক এখন হাতেগোনা। তাই নিজেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হলেই কেবল রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলেন তারা। অন্য সময় সকলেই ম্রো ভাষায় কথা বলে থাকেন।’

তবে তিনি বলেন, ‘যারা রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলেন, তারা জাতিতে ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক। তবে রেংমিটচ্য ও ম্রো ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও রেংমিটচ্য ভাষার সঙ্গে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খুমি ও বম জাতিসত্তার কথ্য ভাষার সঙ্গে কিছু কিছু মিল পাওয়া যায়।’

বর্তমানে রেংপুং হেডম্যান ছাড়াও মাংপুং ম্রো, তিংওয়াই কার্বারি ও লাউলী ম্রো ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা পুরোপুরি জানেন। রেংপুং হেডম্যানের বড় মেয়ে কাইতুনম্রোও এ ভাষায় কথা বলতে পারেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে রেংপুং হেডম্যানের নাতি বান্দরবান সরকারি কলেজের ছাত্র লাংচিং ম্রো এ ভাষাটি শিখছেন।

রেংপুং হেডম্যান বলেন, ‘নতুনরা রেংমিটচ্য ভাষা না শিখলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে এই ভাষা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার জানাচ্ছেন, ‘কীভাবে নিশ্চিত হব রেংমিটচা একটি আলাদা ভাষা? এই প্রশ্নটি বারবারই এসেছে সামনে, বিশেষ করে রেংমিটচা ভাষার অস্তিত্ব জানার পর ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসনসহ আমরা অনেকবারই মুখোমুখি হয়েছি এই প্রশ্নের। অনেকে এমনও বলেছেন, এটা যে ম্রো বা খুমি ভাষার উপভাষা নয়, সেটি কীভাবে নিশ্চিত হলাম আমরা? একটি ভাষা একেবারে আলাদা কি না, তা নির্ণয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা পারস্পরিক বোধগম্যতার যে মানদণ্ড প্রয়োগ করে থাকেন, সেটি দিয়েই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব ভাষাটি উপভাষা না সম্পূর্ণ আলাদা একটি ভাষা। রেংমিটচা ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা প্রয়োগ করেছি ওই বোধগম্যতার মানদণ্ড। এরপর যখন আমরা রেংমিটচা ভাষার সঙ্গে খুমি কিংবা ম্রো ভাষার তুলনা করেছি, তখন এই দুই ভাষাভাষীর পারস্পরিক বোধগম্যতা খুঁজে পাইনি।’

সৌরভ সিকদার জানাচ্ছেন, ‘লফলার প্রাথমিকভাবে রেংমিটচা ভাষাকে মিয়ানমারের ম্রো, খুমি (আওয়া খুমি) ভাষার একটি বৈচিত্র্য বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পিটারসন তাঁর মিয়ানমারের একজন সহকর্মীর মাধ্যমে ম্রো, খুমি ভাষার সঙ্গে রেংমিটচা ভাষার পারস্পরিক বোধগম্যতার মানদণ্ড প্রয়োগ করলে দুটি ভাষা আলাদা বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরে আমরা নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় পাওয়া এই তিন ভাষার উপাত্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে যে তুলনামূলক টেবিল তৈরি করি সেখানেও সাদৃশ্যের চেয়ে অমিলই পেয়েছি বেশি। এমনকি এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে রেকর্ডারও। রেকর্ডার ব্যবহার করে শোনানো হয়েছে ম্রো ও খুমিদের, যাতে তারা কতটুকু বোঝে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এভাবে ধাপে ধাপে প্রমাণিত হয়েছে যে রেংমিচটা একটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। তবে এ সিদ্ধান্তের সমাপ্তি টানতে আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।’

তিনি বলছেন, ‘আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে রেংমিটচা আমাদের জন্য একটি সতর্কসংকেত। তাই এ ভাষার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এটি বলা অযথার্থ নয় যে এটি একটি মৃতপ্রায় ভাষা। আর এ ভাষা রক্ষার জন্য আমাদের হাতে খুবই সামান্য সুযোগ রয়েছে। যার মধ্যে ভাষাটি রেকর্ড করা গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!