৬৫ দালালের দাপট চট্টগ্রাম মেডিকেলে, ফাঁদ পাতা হয় জরুরি বিভাগ থেকে

কমিশনের ভাগ যায় ট্রলিম্যান, সর্দার ও পুলিশের কাছে

জরুরি বিভাগ থেকেই শুরু হয় রোগীর সাথে জোর কদমে হাঁটা। পিছু নেওয়া দালালদের গন্তব্য— ওয়ার্ড। তারপর রোগীকে বুঝিয়ে ‘নায্যমূল্যে ওষুধ কেনা’র নামে পূর্ব গেটে তাদের নির্ধারিত দোকানগুলোতে নিয়ে গিয়ে রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হয় ওষুধের গলাকাটা দাম। স্লিপ কেড়ে নিয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে ওষুধ ধরিয়ে দেওয়া হয় রোগীকে। এবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা। এখানেও থাবা বসায় দালালরা। কখনও কৌশলে, কখনও আবার জোর করেই রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দালালদের পছন্দের ল্যাবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনই চলছে দালালদের এই রমরমা ব্যবসা। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত, এমনকি মধ্যরাতেও এই কাণ্ড চলছে নির্বিঘ্নে।

হাতভাঙ্গা নিয়ে নগরীর মনসুরাবাদ থেকে শনিবার (১২ জুন) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন সুমন। অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া সুমন বাড়ির পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে। সুমনকে নিয়ে তার বাবা সাখাওয়াত হোসেন যখন জরুরি বিভাগে আসেন তখন দুপুর। গিজগিজ করছে রোগী। ট্রলি ও চেয়ার নিয়ে রোগী নিয়ে আয়া ও আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা যখন ওয়ার্ডের দিকে যাত্রা শুরু করে, ঠিক তখনই হাসপাতালের পশ্চিম পাশের বারান্দায় বসে থাকা দালালরা সুমনের পিছু নেন। যথারীতি তার কাছ থেকেও নেওয়া হয় ওষুধের গলাকাটা দাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তাকে করতে হয়েছে দালালদের ঠিক করে দেওয়া ল্যাবে।

চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশে বারান্দায় যেসব দালাল বসে থাকেন তাদের সকলেই চেনে। নবী, সুমন, তপন, রাজু, সাকিন, উত্তম, সাইফুল, নূর হোসেন, বাবু, সমীর, আনোয়ারসহ অন্তত ৬৫ জন দালাল জরুরি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের আবার নিয়ন্ত্রণ করেন জরুরি বিভাগের ‘সর্দার’ এনায়েত। এসব দালাল চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেটের ২৫টি দোকানের বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাদের ডিউটিও আবার রোস্টারভিত্তিতে। সকালে মেডিকেলে দালালি করে দুপুর ও রাতে দোকানে কাজ করেন তারা।

করোনাকালে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ দিয়ে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। রোগীর এই আধিক্যে দালালদের আবার পোয়াবারো। দালালরা আগে থেকেই ট্রলিম্যানদের ম্যানেজ করে রাখে। জরুরি বিভাগ থেকে লিফট দিয়ে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে ট্রলিম্যানরা দুই থেকে আড়াইশ টাকা দাবি করে সচরাচর। প্রতি রোগী থেকে ট্রলিম্যানরা যে টাকা পায়, তার অর্ধেক যায় ‘সর্দার’ এনায়েতের কাছে। দালালদের কমিশনের ভাগও যায় এনায়েতের কাছে।

আর একটি ভাগ পৌঁছে যায় চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের কাছে। এর বিনিময়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে এই দালালদের এক ধরনের ‘নিরাপত্তা’ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই স্বীকার করেছেন, পুলিশ ফাঁড়ির নিস্ক্রিয়তায় এসব দালালের দৌরাত্ম্য বাড়ছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে প্রতিদিনই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে অসহায় অবস্থায় পড়ছে রোগী ও তার স্বজনরা।

জানা গেছে, চমেক হাসপাতালে সক্রিয় দালালদের টার্গেট থাকে অপারেশন বিশেষায়িত ওয়ার্ডগুলোতে। এর মধ্যে রয়েছে ২৬, ২৭, ৩৩, শিশু সার্জারি ও হৃদরোগ বিভাগ। এসব ওয়ার্ড থেকেই মূলত দালালরা রোগীর স্বজনকে বুঝিয়ে তাদের পছন্দমতো ওষুধের দোকান ও ল্যাবে নিয়ে যান।

গত বৃহস্পতিবার (১০ জুন) ২৬ নং ওয়ার্ডে মাসুম নামে এক যুবকের পা ভাঙ্গার অপারেশনের আগে তার স্বজনকে সাড়ে ছয় হাজার ওষুধ কিনতে হয়েছে দালালদের খপ্পরে পড়ে। মাসুম নামের ওই যুবক ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৫ দিন। ভর্তির দিনই এক লোক এসে মাসুমের ভাই মুত্তাকিনকে জানান, তার সাথে দোকানে গেলে তিনি ‘নায্যমূল্যে ওষুধ’ কিনতে সাহায্য করবেন। এরপর তাকে নিয়ে যান মেডিকেলের পূর্ব পাশের সবুজ ফার্মেসিতে। সেখান থেকে প্রথম দিনেই তাকে কিনতে বাধ্য করা হয় সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ।

দালালদের অবাধ বিচরণ প্রসূতি বিভাগেও। এই বিভাগে আসা প্রসূতিদের স্বজনদের সচরাচর জরুরি বিভাগ থেকেই হাত করে ফেলে দালালরা। চিকিৎসকরা বলছেন, সিজারের ক্ষেত্রে হাসপাতালের সরবরাহ করা ওষুধের বাইরে একজন প্রসূতির সাধারণত দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকার ওষুধ কেনা লাগতে পারে। কিন্তু প্রসূতি বিভাগের ৩০, ৩১, ৩৩ ওয়ার্ড ঘুরে অভিযোগ পাওয়া গেছে, হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধই পাওয়া যায় না। দালালদের খপ্পরে পড়ে নায্যমূল্যের দোকানে গিয়েও ওষুধের পেছনে প্রসূতি প্রতি খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। অনেকের আবার ১৫ হাজারেরও বেশি টাকা গেছে শুধু ওষুধের পেছনেই। এসব অভিযোগ করতে করতেই প্রসূতি ও তাদের স্বজনদের অনেকেই আঁড়চোখে ওয়ার্ডে অবস্থান করা দালালদের দেখিয়ে দিয়েছেন এই প্রতিবেদককে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ‘দালাল’ নূর হোসেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমি আট মাস আগে দালালি ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমি না থাকলেও আমার লোক থাকে। আর থাকলেই বা কী। জরুরি বিভাগে আমার মতো অর্ধশতাধিকেরও বেশি দালাল আছে।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটা চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগী ও তার স্বজনরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। এর আগেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আবারও নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!