৫ হাজার দিলেই পরীক্ষা পাস হালিশহরের বেগমজান স্কুলে!

পাস করলেও টাকা, না করলেও টাকা

২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী মোবাশ্বেরা আকতার মৌ। বাবা তিন মাস ধরে বেকার। সদ্য মা হারা মৌ চার ভাইবোনকে নিয়ে থাকে ছোট ভাড়া বাসায়। টানাটানির সংসারে চলে যায় দিন। মায়ের চলে যাওয়ার পর অনেকদিন পড়াশোনা আর হয়নি। তাই এসএসসির টেস্টে দুই বিষয়ে ফলাফল খারাপ হয়। একবার ভাবে পড়াশোনা বাদ দিয়ে পোশাক কারখানায় চাকরি নেবে। কিন্তু তাতেও বাধ সাধে এসএসসির সনদ। সনদ না থাকায় চাকরি পায় না মৌ। তাই ফিরে আসে স্কুলে। ফরম পূরণ ও কোচিং ফি ছাড়াও বাড়তি পাঁচ হাজার টাকার জন্য আটকে যায় ফরম পূরণ। কিন্তু সংসারের হাল ধরতে গেলে তাকে যে করেই হোক এসএসসি পরীক্ষায় পাস করতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে নীতিনৈতিকতা শেখানোর জায়গা, সেখানেই বাসা বেঁধেছে শত অনিয়ম। অনৈতিকতার হাতেখড়ি দিচ্ছে স্বয়ং স্কুল কর্তৃপক্ষ। যার উদাহরণ হালিশহর বেগমজান উচ্চ বিদ্যালয়। নগরীর ৩৮ নং ওয়ার্ড বন্দর থানার পুরাতন ডাকঘর এলাকায় অবস্থিত এ বিদ্যালয়টি ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম শহরের পুরাতন স্কুলের মধ্যে এটি অন্যতম।

জানা যায়, এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীদের মাঝে সব বিষয়ে কৃতকার্য হয়েছে মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী। বাকি সবাই কোনো না কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। এই অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ৪০ জন শিক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত করে রাখে স্কুল কর্তৃপক্ষ। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পুনরায় পরীক্ষা নিয়ে এসএসসিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তবে তা একবিষয়ের জন্য ২ হাজার টাকা আর দুই বিষয়ের জন্য ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে। আবার সেটা ফরম পূরণ ও বাধ্যতামূলক কোচিং ফি বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকার বাইরে। বোর্ড কর্তৃক ফরম পূরণ করার জন্য ফি নির্ধারিত করা হলেও সেক্ষেত্রেও বাড়তি ফি নিচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ— এমন অভিযোগ অভিভাবকদের। অতিরিক্ত এ অর্থ শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে দিতেও প্রতিবাদ জানান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক কর্মী।

অবৈধ অর্থ গ্রহণের ঘটনায় হালিশহর বেগমজান স্কুলের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ কর্মীরা।
অবৈধ অর্থ গ্রহণের ঘটনায় হালিশহর বেগমজান স্কুলের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ কর্মীরা।

অভিভাবক মো. মোমিন বলেন, ‘আমার মেয়ে শারমিনকে সব বিষয়ে পাস করার পরেও ফরম পূরণ ও কোচিং ফি বাবদ আরও বাড়তি ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে। বোর্ডের নির্ধারিত টাকা নিলে তো এতো টাকা নেওয়ার কথা না। তবুও আমরা জিম্মি।’

আরেক অভিভাবক সরওয়ার কামাল বলেন, ‘পাস করলেও টাকা, না করলেও টাকা। স্কুলের সিস্টেম বুঝি না। কার কাছে গেলে যে প্রতিকার পাবো।’

টাকা ফেরত পেয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানায়, ‘আমাদের কাছ থেকে ফরম পূরণ ছাড়া কোচিংয়ের জন্য বাধ্যতামূলক ১৫০০ টাকা দিতে বলেছে। সব বিষয়ে পাস করেছি, তাও ৩ হাজার টাকা দেওয়া লেগেছে। এখন সেখানে থেকে আমি এক হাজার টাকা ফেরত পেয়েছি।’

প্রতিবাদকারী ছাত্রলীগ কর্মী মো. সাদমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বুধবারে শিক্ষার্থীরা আমাকে জানায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা। স্কুল কর্তৃপক্ষ তিন ধরনের ফলাফল প্রকাশ করেছে— যার মধ্যে একটা পাস, একটা স্থগিত ও একটা ফেল। এর মধ্যে স্থগিত ৪০ জন। ফেল করেছে প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী আর সব বিষয়ে পাস করেছে মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী। যারা ফেল করেছে তাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিয়ে ফরম পূরণের সুযোগ দিচ্ছে। আমি একদিন পর যখন বৃহস্পতিবার স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করি তখন তারা টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে। তবে তারা আবার পরীক্ষা নেবে। আর পরীক্ষায় যারা পাস করবে তাদের টাকা ফেরত দেবে। যারা করবে না তাদের টাকা ফেরত পাবে না। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় এ ধরনের কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। যারা ফেল তারা পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে না। তাই আমি একজন সচেতন নাগরিক এবং একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিবাদ জানাই। এরপর তারা শনিবার (১৬ নভেম্বর) চাপের মুখে পড়ে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা যখন টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায় এরপর জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দেই। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তাই আমাদের দাবি ছিল যাদের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে তাদের উত্তীর্ণ দেখাতে হবে। হিসেব করেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ ফেল করা শিক্ষার্থীদের পুনরায় পরীক্ষা নিচ্ছে জামানত নিয়ে। পাস করলে টাকা ফেরত আর না করলে বাজেয়াপ্ত। আবার এসব টাকার কোনো মানি রশিদও নাই। স্কুল কমিটির সভাপতি জাহিদের ছেলে এসব করে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া আমাদের এ যৌক্তিক প্রতিবাদ নষ্ট করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলে পুলিশও পাঠায়। যার প্রমাণ আপনারা সিসিটিভিতে পাবেন। এরপর আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনের কাছে তারা পিছিয়ে যায়।

তিনি উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘ এ সময় স্কুল কমিটির সদস্য বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম আমাদের সাথে ছিলেন। তিনিও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিরোধিতা করেন।’

তবে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা অস্বীকার করে স্কুল কমিটির সভাপতি মো. জাহিদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রত্যেক বছর এরকম কিছু কনফিউশন হয়। সরকারের একটা গেজেট আছে এক বিষয়ে ফেল করলে সেন্টার পারমিশন পাবে না। আমরা যখন শক্ত অবস্থানে গেছি তখন কিছু কিছু গার্জিয়ান, ছাত্ররা এবং কিছু অছাত্র মিলে পত্রিকার সাংবাদিকদের নিয়ে আনে। তারা স্কুল কর্তৃপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে এসব যখন জানাজানি হয়েছে এডিসি শিক্ষা আমাদের বলেছেন কাউকে পাস করাবেন না। আর পাস করাই নাই কেন— এরা বিভিন্ন জায়গায় হাবিজাবি বলে ঝামেলা করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ আমার বাবা অনেক দানশীল। এই দুই-তিন হাজার টাকার জন্য আমাদের কী হবে? এটা ম্যানেজিং কমিটির অগোচরে অনেক স্কুল প্রধান এমন করে কিন্তু আমাদের এমন হয় না।’

পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ সেটা আমরা চাপে পড়ে নেওয়ার জন্য বলেছিলাম। যদি ফেল করে তাহলে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। আর এটায় কিছু কিছু অভিভাবক রাজি হয়েছে। কিছু কিছু রাজি হয় নাই। আমরা রিজেক্ট করছি কেন— তাই এমন করেছে।

কাদের চাপ— এ প্রশ্ন করার পর তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য কথায় চলে যান। পরবর্তীতে বলেন, ‘আমরা যেখানে প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ টাকা স্কলারশিপ দেই, সেখানে এসবের মানে নেই। কেউ প্রমাণ করতে পারলে ব্যবস্থা নেবো। মূলত যারা পরীক্ষায় পাস করেনি তারাই গণ্ডগোল করতে চাচ্ছে এবং অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

এদিকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) আবু হাসান সিদ্দিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটা সূত্রে খবর পাই যে, যারা এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় খারাপ করেছে তাদের পরীক্ষার সুযোগ দেবে। আর তার বিনিময়ে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমরা সেখানে যাওয়ার পর প্রধান শিক্ষিকা জানান পাস করার পর ফেরত দেয়ার শর্তে টাকা নিয়েছে। কিন্তু এমন তো নীতি নেই কিংবা টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। টেস্ট পরীক্ষা একটাই হবে। ফেল করলে ফেল হবে। পুনরায় সুযোগ দেওয়ার সুযোগ নাই। তাছাড়া এসব ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এর কারণ দর্শানোর জন্য প্রধান শিক্ষিকার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তার প্রেক্ষিতে আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমার ধারণা টাকাটা জায়েজ করার জন্যই তারা পরীক্ষা নিতে চেয়েছে। কিন্তু কাদের থেকে নিয়েছে? কেন নিয়েছে? তা এখনও জানা যায়নি। শিক্ষিকা ব্যাখ্যা দিলেই তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে তাদের পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সাপ্লিমেন্টারি হিসেবে নিতে পারে। নাই বা নেওয়া যাবে না এমন কোন বিধান নাই। নিতে পারবে যেমন লিখিতভাবে বিধান নাই, তেমন নিতে পারবে না এমন বিধানও নেই। তবে আমাদের বিধান হল টেস্ট পরীক্ষায় পাস করতেই হবে।’

জামানতের বিনিময়ে পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কথাটা হলো এখানে। এখানে পরীক্ষাটা বড় ব্যাপার না, এখানে লেনদেনটাই তাই বড় ব্যাপার। এটা পুরোটাই অপরাধ। দেখার কিছু নেই।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর শাহেদা ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের সঙ্গে বোর্ডের এ ব্যাপারে কোন যোগাযোগ নাই। প্রেসার যদি কেউ করে থাকে সেটা স্কুল কর্তৃপক্ষ হতে পারে বা যারা স্কুলকে পরিচালিত করে সেই কমিটি হতে পারে। পাস করেনি কিন্তু ৫ হাজার টাকা দিয়ে পাস করিয়ে দেওয়া সেটা তো অনৈতিক ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমাদের কাছে একজন শিক্ষার্থীও যদি লিখিত অভিযোগ জানায় আমি অবশ্যই সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবো। কারণ এটা শুধু অনিয়মই নয়, অনৈতিক ব্যাপার। আমার কথা পরীক্ষায় ফেল করেছে সে পরীক্ষা দেবে না, কিন্তু টাকা দিয়ে তাকে পাস দেখানো যায় না।’

এদিকে হালিশহর বেগমজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নিপু বড়ুয়ার সাথে যোগাযোগ করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রতিবাদকে স্বাগত জানিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চুপ করে থাকা নয়। যেখানে অন্যায় সেখানে প্রতিবাদ করা উচিত। দেশে এখন শিক্ষা আইন আছে। চুপচাপ টাকা পয়সা না দিয়ে শিক্ষাবোর্ডকে বা জেলা প্রশাসনকে জানানো উচিত। একসময় আমি প্রতিবাদ শুরু করেছিলাম। এখন যার যার এলাকায় তাকেই এগিয়ে আসা উচিত।’

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষার অনলাইনে ফরম পূরণ কার্যক্রম গত ৭ নভেম্বর শুরু হয়। ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিলম্ব ফি ছাড়া ফরমপূরণ করা গেলেও বিলম্ব ফিসহ ১৮ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত এসএসসির ফরম পূরণ করা যাচ্ছে। এতে ১০০ টাকা বাড়তি ফি দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। চতুর্থ বিষয়, ব্যবহারিক ও কেন্দ্রফিসহ বিজ্ঞান বিভাগে ফি ১ হাজার ৯৭০ টাকা। ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগে ১ হাজার ৮৫০ টাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!