৫৩৫ কিশোরের ৪৭ গ্যাং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চট্টগ্রাম

মাথার ওপরে 'বড় ভাই'রা

গত ২৬ আগস্ট দিনদুপুরে নগরীর খুলশী থানার জাকির হোসেন সড়কে এমইএস কলেজের গেটের সামনেই ছুরিকাঘাতে খুন হয় স্কুলছাত্র জাকির হোসেন সানি (১৭)। খুনের শিকার সানি যেমন স্কুলপড়ুয়া কিশোর, তেমনি এ খুনে জড়িতরাও সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরুনো কিশোর। খুনের নেপথ্যে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের দুই গ্যাংয়ের বিরোধের জেরেই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ও গ্রেপ্তার কিশোরদের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে এসেছে। আর এসব গ্যাংয়ের নেপথ্যে ছায়া হিসেবে আছে কথিত ‘বড় ভাইরা’।

কিশোর গ্যাংয়ের শিকার হয়ে স্কুলছাত্র সানি হত্যাকাণ্ডই নয় কেবল, গত ৯ মাসে চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছে আরো ৭ জন। এ সময়ে কিশোর অপরাধের কারণে নগরের বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে ১৫টির বেশি। এমনকি এসব খুনে জড়িত তিনজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতও হয়েছে।

সিএমপির তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে এসব গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে করা তালিকায় এরকম কথিত বড় ভাই রয়েছে ৪৭ জন। তারা প্রত্যেকেই একেকটি গ্যাংয়ের দলপতি ও শেল্টারদাতা। আর নগরীতে এসব গ্যাং কালচারে জড়িত কিশোরের সংখ্যা রয়েছে মোট ৫৩৫ জন। তবে সিএমপির কোতোয়ালী থানায় সর্বোচ্চ ১৫০ জন কিশোর এসব গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত থাকলেও পতেঙ্গা ও কর্ণফুলীতে এরকম কোনও কিশোর গ্যাংয়ের নাম উঠে আসেনি সিএমপির করা ওই তালিকায়।

কিশোর গ্যাংয়ের কথিত 'বড় ভাই'রা
কিশোর গ্যাংয়ের কথিত ‘বড় ভাই’রা

সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে কোতোয়ালী থানার জামালখানে আদনান হত্যার পর নগর পুলিশ অপরাধচক্রে জড়িত কিশোর এবং অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা করেছিল। তালিকায় প্রায় ৫৫০ জন কিশোরের নাম এসেছিল। যেখানে নিয়মিত বসে আড্ডা দেয় সেরকম অপরাধপ্রবণ স্পটের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০টি। কোচিংভিত্তিক, রাজনৈতিক, স্কুল-কলেজভিত্তিক, চাকরিজীবী এই ধরনের অন্তত ১৫টি ক্যাটাগরির আড্ডার এই ৩০০ স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন স্পটে আড্ডারত কিশোর-তরুণ দেখলে আটকের কথাও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল নগর পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে কিছুদিন পুলিশ তৎপর থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায় পুলিশের সেই তৎপরতা।

সূত্রমতে, কিশোর গ্যাংয়ের মোট কিশোরের সংখ্যা ৫৩৫ জন। আর তাদের গ্যাংয়ের সংখ্যা ৪৭টি। তাদের নিয়ন্ত্রক কথিত বড় ভাইদের বেশিরভাগই সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা নামধারী। তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদে না থাকলেও তারা সরকার দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে থাকেন।

সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের চার থানায় গ্যাং গ্রুপের মোট সংখ্যা ১৬টি আর সদস্যসংখ্যা ৩১৬ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোর অপরাধীর সংখ্যা কোতোয়ালী থানায়—সদস্য সংখ্যা ১৫০ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৪টি। বাকলিয়া থানার গ্রুপের সংখ্যা ৩টি আর সদস্য সংখ্যা ১৮ জন। চকবাজারে গ্রুপের সংখ্যা ৭টি ও সদস্য সংখ্যা ১১৮ জন। সদরঘাট থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০জন।

একইভাবে সিএমপির উত্তর বিভাগের চার থানায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের সংখ্যা ১৩টি ও সদস্য সংখ্যা ৮৮ জন। এর মধ্যে চান্দগাঁও থানায় গ্রুপের সংখ্যা ২টি ও সদস্য সংখ্যা ৩০জন। পাঁচলাইশ থানায় সদস্য সংখ্যা ১৮ জন ও গ্রুপের সংখ্যা ৩টি। খুলশী থানায় গ্রুপের সংখ্যা ৬টি আর সদস্য সংখ্যা ৩২ জন। বায়েজিদ থানায় গ্রুপ ২টি এবং সদস্য সংখ্যা আট।

এই ৪৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের দলনেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম নিশ্চিত হওয়া গেছে একাধিক সূত্রে। এর মধ্যে রয়েছেন চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রউফ। তার নেতৃত্বে চকবাজার, জামালখান, গণি বেকারী, চন্দনপুরা ও রহমতগঞ্জ এলাকায় সক্রিয় কিশোর গ্যাং। র‌্যাবের হাতে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া কথিত যুবলীগ নেতা নূর মোস্তফা টিনুর গ্রুপ বাকলিয়া, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশ ও চকবাজার এলাকায় সক্রিয়। কথিত যুবলীগ নেতা এসরারুল হক এসরালের নেতৃত্বে একাধিক গ্রুপ নগরের বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, শমশেরপাড়া, কালুরঘাট ও পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয়। নগরীর মুরাদপুর, নাসিরাবাদ পাঁচলাইশ এলাকায় সক্রিয় দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডার মো. ফিরোজের গ্রুপ। নগরীর দুই নম্বর গেট, জিইসি, জাকির হোসেন রোড, আল ফালাহ গলি ও নাসিরাবাদ এলাকায় সক্রিয় কথিত যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশা গ্রুপ।

নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, পলিটেকনিক ও শেরশাহ এলাকায় রয়েছে যুবলীগ নেতা আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের গ্রুপ। নগরীর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে সক্রিয় রয়েছে জহুরুল আলম জসিমের একটি গ্রুপ। নগরীর লালখান বাজার এলাকায় সক্রিয় রয়েছে লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত মোহাম্মদ বেলালের গ্রুপ। নগরের জামালখান, চেরাগী পাহাড়, হেমসেন লেইন, লাভলেইন, নন্দনকানন, এনায়েতবাজার এলাকায় সক্রিয় ছিল দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরীর গ্রুপ। তিনি গত ২৯ মে কারাগারে খুন হলে তার গ্রুপের সদস্যরা এখন চুপচাপ রয়েছে। যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমনের গ্রুপ সক্রিয় সিআরবি, কদমতলী, আমবাগান ও টাইগারপাস এলাকায়।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) আমেনা বেগম বলেন, ‘কথিত বড় ভাই ও তাদের গ্যাংয়ের সদস্যদের তালিকা আমরা করছি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যার বিরুদ্ধেই অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’

আগামী পর্বে পড়ুন
চট্টগ্রামের স্কুল ডিজে আড্ডা থেকে ফেসবুক—সবখানেই কিশোর গ্যাং!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!