৪ হাজার শ্রমিককে ঝুঁকিতে ফেলে জেনারেটর নিয়ে ‘ঘুম নেই’ চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরের

একটি জেনারেটর নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’তে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান ফোর এইচ গ্রুপের ৪ হাজার শ্রমিকের চাকরি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, একটি সাউন্ডপ্রুফ জেনারেটরের জন্য জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডই বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর (মেট্রো)। অথচ পরিবেশের সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই বসানো হয়েছিল এ জেনারেটর।

অভিযোগে জানা যায়, শব্দ দূষণের কারণ দেখিয়ে এক মহিলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ হাজার লোকের কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিবিশেষের পক্ষাবলম্বন করে পরিবেশ অধিদপ্তর ফোর এইচ গ্রুপের পরিচালনাধীন নগরীর বালুচড়ার ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড বন্ধের হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। শুনানির নামে বার বার ডেকে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে।

জানা গেছে, নগরীর বালুছড়া জালালাবাদ এলাকায় ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডের কারখানার পেছনের অংশে বসানো হয়েছে একটি সাউন্ডপ্রুফ জেনারেটর। বিদ্যুৎ না থাকলে চালানো হয় জেনারেটরটি। ২৪ ঘণ্টায় দিনের ৪ ঘণ্টাও চলে না ওই জেনারেটর।

জানা গেছে, বালুচড়া চট্টগ্রাম সেনানিবাস আবাসিক এলাকার আশকারাবাদ মিস্ত্রিপাড়া এলাকার বজল আহমদের মেয়ে শামীমা আক্তার বাদী হয়ে গত ২ ডিসেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামে একটি অভিযোগ দেন। মহানগর কার্যালয়ে দেওয়া অভিযোগে তিনি জানান, ফোর এইচ অ্যাপারেলসের বসানো জেনারেটর থেকে শব্দ দূষণ হচ্ছে। এটি আমলে নিয়ে এনফোর্সমেন্ট মামলা (নং ২৭৯) হিসেবে নথিভুক্ত করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ের শুনানির জন্য গত ১৩ ডিসেম্বর হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয় ফোর এইচ অ্যাপারেলসকে।

ওই দিন ফোর এইচ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুনানিতে হাজির হলে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়— ‘হয় জেনারেটর সরাতে হবে, না হয় ফোর এইচ গ্রুপের কারখানা সরাতে হবে।’ পরে পরিবেশের অধিদপ্তর থেকে টিম পাঠিয়ে সরেজমিনে রিপোর্ট দেওয়া হয়। পরবর্তীতে একই বিষয়ের ওপর ১১ জানুয়ারি পুনরায় শুনানির নোটিশ যায় ফোর এইচ গ্রুপকে। এতে হাজির হলে পুনরায় ওই জেনারেটর সরানোর তাগাদা দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী।

ওই দিন জেনারেটর রুমের পশ্চিম পাশে শব্দ দূষণকারী রোভার বন্ধ করে দিয়ে দেওয়াল তুলে দেওয়ার জন্য বলা হয়। নির্দেশনা অনুসরণ করে ফোর এইচ অ্যাপারেলসের পক্ষ থেকে ওই পাশে দেয়াল নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এরপরও পুনরায় আবার শুনানিতে ডাকা হয় মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি)। এতে উপস্থিত ছিলেন ফোর এইচ গ্রুপের উপ মহাব্যবস্থাপক একেএম হেলালুজ্জামান।

কিন্তু এনফোর্সমেন্ট মামলার বাদী শামীমা আক্তার এতে উপস্থিত হননি। ফলে আবার বুধবার সকালে উপস্থিত থাকতে বলেন ফোর এইচ গ্রুপের উপ মহাব্যবস্থাপককে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এভাবে একটি বিষয়কে দ্রুত নিষ্পত্তি না করেই বার বার ডেকে হয়রানি করা হচ্ছে। মামুলি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তাদের হয়রানিতে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে, এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি জেনারেটরটি সরিয়ে অন্য স্থানে স্থাপনের জন্য তিন মাসের সময় চেয়ে আবেদন করেন ফোর এইচ অ্যাপারেলস থেকে। সময় চাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করে তাদের আবারও ডাকা হয় শুনানিতে। অপরদিকে আপত্তি ওঠা জেনারেটরটি সরিয়ে অন্যত্র বসানোর কাজও শুরু দিয়েছে ফোর এইচ অ্যাপারেলস। কারখানার সামনে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আনুষাঙ্গিক সব কিছু প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রায় ২ কোটি টাকা।

জানা গেছে, বালুছড়া জালালাবাদ এলাকায় ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডের কারখানাটি পরিবেশ অধিদপ্তরেরই ছাড়পত্র নিয়ে তৈরি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ কলকারখানা অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। এটি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) কর্তৃক অনুমোদিতও।

ফোর এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালে নগরের বালুচড়া জালালাবাদ ফোর এইচ অ্যাপারেলসের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ৪০০০ শ্রমিক কাজ করছে। এখন শুধু একটি জেনারেটরের জন্য শব্দদূষণের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়ে ৪ হাজার শ্রমিককে ঝুঁকিতে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর।

কল-কারখানার কোড মেনেই পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে ফোর এইচ অ্যাপারেলসের উপ মহা-ব্যবস্থাপক একেএম হেলালুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা তিন মাস সময় চেয়েও সময় পাচ্ছি না পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে। অথচ সময় প্রার্থনা করে সময় পাওয়ার অধিকার আমাদেরও আছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জেনারেটরটি অন্যত্র সরানোর কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছি। এরপরও আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। দেশের রপ্তানিমুখী একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ সরকার এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে।’

জানতে চাইলে চসিকের ২ নং জালালাবাদ-বালুচড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল বাবু বলেন, একজন মহিলার জন্য ৪০০০ লোকের কর্মসংস্থান বন্ধ করে দেওয়া এটা কোনো আইনে পড়ে না। একটি জেনারেটরে জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের হয়রানি সহ্য করার মতো নয়। আশা করবো বিষয়টির যৌক্তিক সুরাহা হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগকারী শামীমা আক্তারের মোবাইল ফোনে বারবার চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বার বার শুনানি করে ডাকার অর্থ বা উদ্দেশ্য হয়রানি নয়। এটা আমার অফিসের পলিসি। কারণ দীর্ঘ সময় দিলে তারা কাজটি করবেও না। জেনারেটর সরাবে না। কিন্তু সময় পার করবে। ফোর এইচ অ্যাপারেলস জেনারেটরটি অন্যত্র সরানো কাজ শুরু করেছে সেটি আমি জানি। কাজটি দ্রুত করার জন্যই শুনানির জন্য ডেকে এক দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হচ্ছে।

এএস/কেএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!