৪ হাজার কোটি টাকায় চট্টগ্রামে বিদ্যুতের ‘উন্নয়ন’, দেড় হাজার কোটি শেষ, মানুষের দুর্ভোগ তবু অশেষ

৪ মাসে অফিস খরচেই গেছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা

চট্টগ্রাম নগরী ও আশেপাশের এলাকায় বছরের পর বছর ধরে চলছে বিদ্যুতের জরুরি মেরামত, সংস্কার, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কাজ। এজন্য নগরীর জনবহুল ও বাণিজ্যিক স্পট ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দীর্ঘ সময় ধরে, এমনকি পুরো দিনই বন্ধ রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে বিদ্যুতের ‘শাটডাউন’। অথচ চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে এরই মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে একটি প্রকল্পের আওতায়।

এখন আবার ওই একই প্রকল্পের আওতায় ‘উন্নয়নের’ জন্য খরচ করা শুরু হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। মাত্র চার মাসে এরই মধ্যে সেখান থেকে খরচ করে ফেলা হয়েছে ২৮৬ কোটি টাকা। তাতে শুধু অফিসের টুকিটাকি খরচেই গেছে সাড়ে সাত কোটি টাকা মাত্র! আর যথারীতি চলতি বছরের শুরু থেকে নতুন করে শুরু হয়েছে শাটডাউনের খেলা। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার ছাড়াও অন্যান্য দিনে সংস্কারের নামে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হচ্ছে।

যে ‘জরুরি মেরামত ও সংরক্ষণ’ কাজের জন্য চট্টগ্রামে বিদ্যুতের এমন আসা-যাওয়া, দিনভর শাটডাউন করা হচ্ছে— এসব হচ্ছে ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন চট্টগ্রাম জোন’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায়। এভাবে বিদ্যুতের লাইন বন্ধ রেখে বছরের পর বছর ধরে ‘উন্নয়নের কাজ’ চালানো হলেও ‘শাটডাউন’ থেকে মুুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। রেহাই মিলছে না বিদ্যুতের দুর্ভোগ থেকে।

জানা গেছে, পিডিবি চট্টগ্রাম জোনের ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন’ নামের এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। ছয় বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। এতে খরচ করা হয় ১ হাজার ৪২১ কোটি টাকা।

তবে এর বড় কোনো সুফল এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। কিন্তু তার আগেই ওই একই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ ‘শুরু’ হয়ে যায় চট্টগ্রামে। তবে তা কাগজেকলমে, বাস্তবে নয়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের মেয়াদ ধরা হয় আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। আর এই সময়ের জন্য প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ৫৫১ কোটি ৯০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।

তবে পিডিবির সংশ্লিষ্টরা এখন বলছেন, করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করা যায়নি। পিডিবির হিসাব অনুসারে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে নির্ধারিত প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সালের জুলাই থেকে। তবে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে কাজ শুরু হয়েছে ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে। আর এই চার মাসেই খরচ করে ফেলা হয়েছে ২৮৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র অফিস খরচই দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বলা হচ্ছে, এই সময়ে কাজের অগ্রগতি হয়েছে ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

জানা গেছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ নির্ধারিত থাকলেও এখন সেই মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য তদবির করছেন পিডিবি চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম জোনের ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘লাইন নির্মাণ, আগাম ক্রয় ও ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে মন্ত্রণালয়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছি। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন রয়েছে আমাদের। কারণ করোনার কারণে প্রকল্পের সিকিভাগ কাজও আমরা শুরু করতে পারিনি। কাজের অগ্রগতির জন্য আমরা শাটডাউন রেখে লাইনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করছি। তবে পুরোদমে কাজ খুব শীঘ্রই শুরু হবে।’

জানা গেছে, বাস্তবে চার মাস এবং কাগজেকলমে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম জোনের ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন’ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ খরচ হয়েছে ২ কোটি ৬২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, কর্মচারীদের বেতন খাতে গেছে ১ কোটি ৪ লাখ ৭ হাজার টাকা। কমকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি নগদায়নে (জমা ছুটি বিক্রি) খরচ হয়েছে ২৭ লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

টিএ/ডিএতে গেছে ৪৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, ওভারটাইম ভাতা দিতে হয়েছে ৭ লাখ ৮৩ হাজারর টাকা, বিদ্যুৎ ভাতা হিসেবে খরচ হয়েছে ১০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সাধারণ ভবিষ্য তহবিল বা জিপিএফ বাবদ গেছে ৪১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, জিপিএফ/সিপিএফের সুদ হিসেবে গেছে ৪২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

এই সময়ে আসবাবপত্র কিনতে খরচ হয়েছে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। লেজার প্রিন্টারসহ কম্পিউটার কেনা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকার। অফিস সরঞ্জাম কেনায় গেছে ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ডাক ও টেলিফোন খাতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

এছাড়া অন্যদিকে বিজ্ঞাপন, সভা খরচ, আপ্যায়ন খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে ২২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। মেরামত, সংরক্ষণ, স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদিতে গেছে ২২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। পেট্রোল, ডিজেল এন্ড সিএনজি, লুব্রিকেটিং অয়েল কিনতে ব্যয় হয়েছে ৩২ লাখ টাকা

পরামর্শক ফি (কুতুবদিয়া) বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮৬ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। মেরামত, সংরক্ষণ, স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদিতে খরচ হয়েছে ২৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ইনস্যুরেন্স-ভ্যাট-ট্যাক্সে গেছে ৪ লাখ টাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!