৩ বছরেই অঢেল সম্পদ বাঁশখালীর লিয়াকতের, বড় ‘চাঁদাবাজি’র অভিযোগ দুদকে

১৮ চেকেই দেড় কোটি টাকার ‘চাঁদাবাজি’

নিজের তেমন কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও শত কোটি টাকার মালিক তিনি। ২০১৫ সালে লাখ টাকার জন্য চেক প্রতারণার মামলায় জেল খাটলেও গত কয়েক বছরে নগরে কিনেছেন ফ্ল্যাট, করেছেন বাড়ি। নিজের জন্য কিনেছেন আলিশান গাড়িও। এছাড়া স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও নিকটাত্মীয়দের নামেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

নাম তার লিয়াকত আলী। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তিনি। দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক এই কার্যনির্বাহী সদস্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন গত বছরের জানুয়ারিতে।

চলতি বছরের ৫ ও ৮ জুন এসব তথ্য জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন মো. সেলিম উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ‘বাঁশখালীর গণ্ডামারায় এস আলম গ্রুপের ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের (২০১৬ সালে) ঘোর বিরোধী ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী। পরে ‘বসতভিটা ও গোরস্থান রক্ষা কমিটি’ নামে একটি নামমাত্র সংগঠন তৈরি করে প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সময় উন্নয়ন প্রকল্প ও সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও উস্কানি দিয়ে এলাকাবাসীকেও প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড় করান। মূলত তারই উস্কানিতে ওই বছর এলাকাবাসীর সঙ্গে প্রশাসনের সংঘর্ষে নিহত হন পাঁচ সাধারণ মানুষ।’

অভিযোগে বলা হয়, পরে বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে প্রভাব খাটিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন প্রতিনিধির কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেন লিয়াকত। এছাড়া এস আলম পাওয়ার প্লান্টের ভূমি সমন্বয়কারী মো. নাছির উদ্দিনের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ১৮টি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন তিনি। এ সংক্রান্ত ১৮টি চেকের নম্বর ও তারিখ উল্লেখ করা হয় অভিযোগপত্রে।

২০১৪ সালের ২৬ মে ৯৪৭১৭৬২ নম্বর চেকের মাধ্যমে মো. নাছির উদ্দিনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ১০ লাখ টাকা। একই বছরের ২০ জুন ৯৫৫৬১৫৬ নম্বরের চেকে ১০ লাখ, ২৯ জুন ৯৫৫৬১৫১ নম্বরের চেকে ১০ লাখ, ১৬ জুলাই ৯৫৫৬১৯২ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ২৩ জুলাই ৯৫৫৬১৩৩ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ১২ আগস্ট ৯৭২১৫০৩ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ২৪ আগস্ট ৯৭২১৬০৮ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ৪ সেপ্টেম্বর ৯৮২১২৪০ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ২৮ সেপ্টেম্বর ০৩৬৫৬৮৮ নম্বরের চেকে ১০ লাখ, ২ অক্টোবর ৯৮২১২৪১ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ১৯ অক্টোবর ৯৮৯৭৮৯০ ও ৯৮৯৭৮৯১ নম্বরের চেকে ১০ লাখ, ২১ নভেম্বর ৯৮৯৭৮৪৮ নম্বরের চেকে ১০ লাখ এবং ১৪ ডিসেম্বর ৯৮৯৭৮৮৯ নম্বরের চেকে ১০ লাখ টাকা।

এছাড়াও ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি ০৩৬৫৬৯৬ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ১০ ফেব্রুয়ারি ০৩৬৫৬৯৭ নম্বরের চেকে ৫ লাখ, ২৫ মার্চ ০৩৬৫৬৯৮ নম্বরের চেকে ১০ লাখ এবং ২৪ মে ৪৭১৩৭০৪ নম্বরের চেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নেন।

এছাড়া ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে নামে-বেনামে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, নিজের বোন ও বোন জামাইসহ বিশ্বস্তদের নামে শত শত একর জমি কিনেছেন লিয়াকত। এ সংক্রান্ত জায়গার খতিয়ান ও তারিখসহ ৩৬টি দলিলের নম্বর তুলে ধরা হয় দুদকে দেওয়া সেই অভিযোগপত্রে।

লিয়াকত আলীকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার বিষয়ে এস আলম পাওয়ার প্লান্টের ভূমি সমন্বয়কারী মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘১ কোটি ৩০ লাখ নয়, বরং ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লিয়াকত আলীকে আমি ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিয়েছি। তার মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে, বাকি ৪০ লাখ টাকা ক্যাশ দেওয়া হয়েছিল তাকে। প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করার শর্তে বিভিন্ন সময় তিনি এসব টাকা নিয়েছেন।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে থেকে এ পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে সংঘর্ষে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের প্রত্যেকের মৃত্যুর নেপথ্যে রয়েছেন বিএনপির বহিষ্কৃত এ নেতা।

এ প্রকল্পে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল। তখন এস আলম পাওয়ার প্লান্টের কারণে আশপাশের এলাকার ১০ হাজার মানুষ ভিটে-বাড়ি ছাড়া হবে এবং এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেবে— অভিযোগ রয়েছে এমন গুজবও ছড়ান লিয়াকত আলী। অভিযোগ করা হয়, তার উস্কানিতে প্রশাসনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয়রা। এতে চারজন নিহত হন।

এরপর ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে লিয়াকতের নির্দেশে গুলিতে নিহত হন মুহাম্মদ আলী নামে আরও একজন। সে হত্যামামলায় গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) লিয়াকত আলীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার কাজ শুরু করেছেন চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালত।

এছাড়াও ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল ওই প্রকল্পে বেতন ও কর্মঘণ্টা নিয়ে বিরোধের জেরে সংঘর্ষে নিহত হন আরও পাঁচজন। এ ঘটনায়ও তখন লিয়াকতকে পরোক্ষভাবে দায়ী করেছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন।

এদিকে দুদকে অভিযোগ দেওয়া মো. সেলিম উল্লাহ বলেন, ‘এস আলম বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্টের তিন ধাপে আন্দোলনের নেপথ্যে ছিলেন চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। আন্দোলনে নিহত ১০ জনের মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। এসব আন্দোলন ছিল তার চাঁদা আদায়ের কৌশল। অন্দোলনের ভয় দেখিয়ে তিনি এস আলম পাওয়ার প্লান্টের ভূমি সমন্বয়কারী মো. নাছির উদ্দিনের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেছেন। এসব টাকা দিয়ে লিয়াকত গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।’

তিনি আরও বলেন, ‘লিয়াকত প্রতিটি জায়গার মালিক ও প্রকল্পে কাজ করা ঠিকাদারদের জিম্মি করে কমিশন হাতিয়েছে। এছাড়া সরকারি খাস জমি বিক্রি করেও এস আলমের কাছ থেকে হাতিয়েছেন টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত তার এসব টাকা এখন সরকারের উন্নয়নের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যয় হচ্ছে। তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্তে আমি দুদকের কাছে অভিযোগ দিয়েছি।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে লিয়াকত আলী বলেন, ‘টাকা নেওয়ার বিষয়ে নাছিরকে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেন। আপনাদেরকে বলে কী হবে? সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা ছাড়া আমি কাউকে জবাবদিহি করতে রাজি না। সাংবাদিক হিসেবে আপনাদের যা ইচ্ছা তা লিখতে পারেন। এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।’

এনইউএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!