৩ কারণে চট্টগ্রামে বাড়ছে ক্যান্সার, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারই ‘হটস্পট’

চিকিৎসায় ভরসা শুধু চমেক হাসপাতাল

চট্টগ্রামে ক্যান্সার ছড়াচ্ছে শুঁটকি, তামাক ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা। সেই সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ, ঝাল তরকারি ও লাল মাংসও ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্যান্সারের বিষ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশিরভাগেরই বাড়ি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে। ক্যান্সারের রোগী বেশি চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আসা রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যান্সার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ তামাক সেবন, শুঁটকিতে ডিটিটির ব্যবহার ও কাজিন ম্যারেজ বা নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা। ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। সে তুলনায় নগরীতে ক্যান্সারের রোগী অনেকটাই কম।

চট্টগ্রামে ক্যান্সারের ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ তিনটি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজির অধীনে পরিচালিত ‘ল্যাবরেটরি অব ইউকারেউটিক জিন এক্সপ্রেশন অ্যান্ড ফাংশন’ এবং চিটাগাং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিল্ড্রেন সার্জারি (ক্রিকস) যৌথভাবে এক সমীক্ষা চালায়।

ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশই কক্সবাজার জেলার। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া উপজেলায় এ হার ১৫ শতাংশ করে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের আরেকটি উপজেলা পটিয়ায় ক্যান্সার আক্রান্তের হার ১৩ শতাংশ। উত্তর চট্টগ্রামের মধ্যে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় এ হার ১৩ শতাংশ।

দক্ষিণ চট্টগ্রামে এ হার বেশি হওয়ার পেছনে শুঁটকিতে ডিডিটি কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত তামাক সেবন ও রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে অন্যতম ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় ওই প্রতিবেদনে। তবে কোনো কোনো চিকিৎসক বলছেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের অতিরিক্ত ঝাল, লাল মাংস খাওয়ার প্রবণতা এবং উপকূলীয় এলাকার অধিবাসীদের সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি খাওয়ার ঝোঁক থেকে ক্যান্সার বেশি হচ্ছে।

দেখা গেছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ৪০ থেকে ৬০ বছর এবং ৫০ থেকে ৬০ বছর— এই দুই সময়ের মধ্যে। এই দুই বয়সসীমায় আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ করে।

চট্টগ্রামে ‘ক্যান্সার স্পট’ চিহ্নিত

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রামে ‘ক্যান্সার স্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে ইতিমধ্যে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় স্তন, জরায়ু এবং খাদ্যনালীর ক্যান্সারের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে সীতাকুণ্ড-মিরসরাই এলাকায় ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এসব এলাকার মানুষের মধ্যে ক্যান্সার বেশি কেন হচ্ছে— তা গবেষণার বিষয় বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। তারা এও বলছেন, এসব এলাকায় ক্যান্সার বিস্তারের কারণ চিহ্নিত করে তা সমাধান করা হলে মানুষ ক্যান্সার থেকে অনেকটাই রক্ষা পাবে।

ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা কেন বাড়ছে দিনের পর দিন— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. আলী আজগর চৌধুরী বলেন, ‘অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মুখরোচক ঝালযুক্ত খাবার, ধুমপান, শুঁটকি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্বাস্থ্যের প্রতি অসেচতনতা, খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থের সংযুক্ততা ইত্যাদিই মূলত এই অঞ্চলের লোকদের ক্যান্সার হওয়ার জন্য দায়ী। স্ক্রিনিংটা ভালোভাবে না হওয়ায় লোকজন এ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছে না।’

ডা. আলী আজগর বলেন, ‘উপকূলের মানুষ সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি বেশি খায়। সমুদ্রে রাসায়নিক বর্জ্য ফেলা হয়। এসব বিষাক্ত বর্জ্য সাগরের মাছের পেটে ঢোকে। এ ছাড়া শুঁটকি তৈরির সময় সারসহ একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।’

তিনি এও বলেন, ‘বাংলাদেশে যত মানুষ ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে তার ৬০ ভাগ মারা যাচ্ছে তামাক থেকে। তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা থাকতে হবে। সিগারেট, পান, জর্দা বর্জন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের মূল কারণই তামাক। ধোঁয়াবিহীন তামাকও রয়েছে এর সাথে।’

ভরসা শুধু চমেক হাসপাতাল

চট্টগ্রামে সরকারিভাবে ক্যান্সার রোগীর সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের বর্হিবিভাগে প্রতিদিন ক্যান্সার রোগী আসছেন ১৫০ থেকে ২০০ জন। এ বিভাগে ইনডোর সিট রয়েছে ২৪টি। ডায়াগোনোসিস রেফার্ড রোগীরাই এখানে আসেন সাধারণত। এ ওয়ার্ডে নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন আনা হয়েছে। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের জন্য বসানো হয়েছে থেরাপি মেশিন।

জানা গেছে, গত বছর নতুন ও পুরাতন মিলে চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৭ হাজার ক্যান্সার রোগী। এর মধ্যে নতুন রোগী ছিল ৪ হাজার ৬৩৫ জন।

রেডিওথেরাপি ওয়ার্ড ও বর্হিবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতবছর চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৬০ ভাগই ছিলেন মহিলা। অন্যদিকে পুরুষ ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারের হার শতকরা ৪০ ভাগ, গলাজনিত কারণে শতকরা ২০ ভাগ, পায়ুপথের ক্যান্সারের রোগী শতকরা ৭ ভাগ, পাকস্থলীর ক্যান্সারে ভোগা ৭ ভাগ, খাদ্যনালীর ক্যান্সারের রোগী শতকরা ৫ ভাগ। নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের রোগী শতকরা ২৫ ভাগ, জরায়ু ক্যান্সারের রোগী ২০ ভাগ, গলাজনিত কারণে ক্যান্সারের রোগী শতকরা ১৫ ভাগ, ফুসফুসের ক্যান্সারে ভোগা ৯ ভাগ, পাকস্থলীর ক্যান্সারের রোগী শতকরা ৭ ভাগ।

চিকিৎসা নিতে দেরি অবহেলায়

রেডিওথেরাপি বিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই প্রাথমিক পর্যায়ে অসচেতনতার অভাবে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করেছেন।

রেডিওথেরাপি বিভাগে চিকিৎসাধীন আব্দুল আলী জানান, তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে গলায়। তিনি প্রতিদিন এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি খেতেন। সাথে পান-জর্দা খাওয়ার অভ্যাসও ছিল। একই বিভাগে ভর্তি রণজিত কুমারও প্রচুর ধুমপান করতেন। অ্যালকোহলও খেতেন। ২ থেকে ৩ মাস আগে তার বমি হতো। পেটেও ব্যথা লাগতো। পরে জানলেন, তার ক্যান্সার।

চতুর্থ বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে নবনী দাশের গর্ভফুল ছিড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে সারাদিন তাকে রেখে রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও এরপর থেকে তার তলপেটে ও প্রস্রাবের রাস্তায় ব্যথা অনুভব হতো। প্রথমে ডাক্তার দেখিয়েছেন গ্রামে। পরে ব্যথা তীব্র হয়ে উঠলে চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসে বর্হিবিভাগে দেখান। সেখানেই ধরা পড়ে তার জরায়ুতে ক্যান্সার।

ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের (আইএআরসি) দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ২২ হাজার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!