৩২ বছরের চাকরি শেষে চট্টগ্রামের ডা. সূযত পালের নতুন মিশন এবার

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা

১৯৬২ সালের ১২ নভেম্বর এক বৃষ্টিভেজা শীতের রাতে জন্ম যে শিশুটির, বাবা তার নাম রাখলেন সুযত। পরবর্তীতে বাবার মুখেই জেনেছেন নামটির অর্থ— পরিমিত। বাবা চেয়েছিলেন কথায় পরিমিত হয়ে কাজে হবেন অপরিমিত। বাবার সেই স্বপ্নপূরণে নিজের শ্রম ও প্রচেষ্টায় হয়ে গেলেন ডাক্তার। দীর্ঘ ৩২ বছর চিকিৎসাসেবার চাকরি শেষে বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) তিনি গেলেন অবসরে।

তিনি চট্টগ্রামের চিকিৎসা অঙ্গনের জীবন্ত কিংবদন্তী অধ্যাপক ডা. সূযত পাল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সদ্য বিদায়ী এই বিভাগীয় প্রধানকে বিদায় সংবর্ধনা দিতে বৃহস্পতিবার জড়ো হয়েছিলেন তার সহকর্মীরা। চমেক হাসপাতাল থেকে বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে তার সহকর্মী চিকিৎসকরা অকপটে স্মরণ করেছেন তার অবদানের কথা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠেছে অনেকের।

দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ডা. সূযত পালের সংসার।
দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে ডা. সূযত পালের সংসার।

১৯৮৭ থেকে ২০২১— ৩২ বছরের এই দীর্ঘ কর্মময় জীবন নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সূযত পাল। খোলামেলা আলাপচারিতায় তিনি টেনে এনেছেন তার কর্মজীবনের নানান স্মৃতি। কোভিড ও ডেঙ্গুকালীন কঠিন হাতে চিকিৎসাসেবার দেওয়ার সময়টুকুকেই জীবনের সেরা কাজ বলে জানিয়েছেন নামি এই চিকিৎসক।

১৯৬২ সালের ১২ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীর আমানবাজার শিকারপুরে জন্মগ্রহণ করেন সূযত পাল। বাবা ছিলেন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক।

১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাস করে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ছিল তার প্রথম কর্মস্থল। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমফিল শেষ করেন প্যাথলজিতে। ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এফসিপিএস শেষ করে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান বা আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন সূযত পাল। সেখান থেকে আবার তাকে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এরপর ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১ বছর দায়িত্ব পালন করেন চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। ২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন আসছিলেন। এই সময়কালে আমূল পাল্টে ফেলেন ১৩, ১৪ ও ১৬ তিন মেডিসিন ওয়ার্ডের সাবিক কার্যক্রম। এ সময় তৈরি করা হয় বিশেষায়িত কয়েকটি ইউনিট। এর মধ্যে রয়েছে— ১৪ নং ওয়ার্ড বাত-ব্যাথার ইউনিট, ও হাইপারটেনশন রোগীদের জন্য হোপ ক্লিনিক, বয়স্কদের চিকিৎসাসেবা উইং ও কোভিড-উত্তর রোগীদের জন্য কোভিড পরবর্তী চিকিৎসা ও রিহ্যাবিলিটিশন ইউনিট। সম্প্রতি তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ আলম বীরউত্তম মিলনায়তনে ডা. সূযত পালকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ আলম বীরউত্তম মিলনায়তনে ডা. সূযত পালকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে ডা. সূযত পাল বলেন, ‘দীর্ঘ কর্মজীবনে যা চেয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ভয়াবহতা এবং গত দুই বছর কোভিডের সময়কালে লড়েছি এসব রোগের সাথে।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড চিকিৎসা টিমের প্রধান ফোকালপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. সূযত পাল। সেই সময়কার কথা বলতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘প্রথমে নিজেও কোভিডের চিকিৎসাসেবা দেওয়া নিয়ে আতঙ্কিত ছিলাম। কাছের বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র, জুনিয়র— কত সহকর্মী কোভিডে আক্রান্ত হল। কেউ মারাও গেলেন। কিন্তু আমরা দমে যাইনি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিডের চিকিৎসাসেবায় রেড ও ইয়েলো জোন তৈরি করে আমরা কোভিড উপসর্গের রোগী ও কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করলাম। মেডিসিন বিভাগের সাথে গাইনি, নাক, কান, গলা, নিউরো মেডিসিন, কিডনি, হৃদরোগসহ সব ওয়ার্ডের চিকিৎসাসেবার সমন্বয় করা হল হাসপাতালের রেড ও ইয়েলো জোনে। ডাক্তারদের নিয়ে মনিটরিং টিম তৈরি করা হল।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবির, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, সব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কোভিড ক্রান্তিকালে একটা টিমওয়ার্ক করেছেন। যা আমার পেশাগত জীবনের সেরা অর্জন। কাছ থেকে মৃত্যু দেখেছি। আবার দেখেছি মৃত্যুর দুয়ার থেকে কোভিড রোগীর বেঁচে ফেরা।’

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) মেডিকেল কলেজের সুদীর্ঘ কর্মজীবন সফলভাবে শেষ করলেন ডা. সূযত পাল। তবে নিয়ম অনুযায়ী আগামী এক বছর অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকবেন।

পিআরএলে যাওয়া এই শিক্ষক ও চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ও গবেষণা কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শাহ আলম বীরউত্তম মিলনায়তনে ডা. সূযত পালকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাহেনা আক্তার, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইউরোলজি বিভাগের প্রধান ডা. মনোয়ার উল হক, অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. প্রণয় কুমার দত্ত, গাইনি এন্ড অবস্ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক শর্মিলা বড়ুয়া, রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুভাষ মজুমদার, নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এস. এম. নোমান খালেদ চৌধুরী, অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রঞ্জন কুমার নাথ, সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল হক, মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ হাসান চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. এমএ সাত্তার প্রমুখ।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ডা. সূযত পাল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। এছাড়া তিনি কলেজের গ্রাজুয়েট ও পোস্টগ্রাজুয়েট কার্যক্রমে একাডেমিক কো-অর্ডিনেটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন উপাধ্যক্ষেরও। সবমিলিয়ে তিনি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সবদিক সামলে চিকিৎসাসেবায় মনোযোগী ছিলেন।

দুই কন্যা সন্তানের জনক ড. সুযত পাল। বড় মেয়ে কানাডাপ্রবাসী। ছোট মেয়ে সম্প্রতি সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। স্ত্রী সীমা বিশ্বাস স্কুলশিক্ষক।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কী করবেন— চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সূযত পাল বললেন, ‘বাকি জীবনও শিক্ষকতা করেই কাটিয়ে দিতে চাই। আগামী দিনগুলোতে মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতায় জড়িত থাকবো।’

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!