৩১ হাই ফ্লো ক্যানোলা চট্টগ্রামের প্রধান দুই হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সম্বল, ৫৩টিই অচল

রোগী বাঁচাতে আইসিইউর চেয়েও বেশি দরকার হাই ফ্লো

চট্টগ্রামে ধারাবাহিকভাবে যেমন বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা, চিকিৎসা পাওয়ার আশায় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের ছোটাছুটির পরিমাণও সেভাবেই বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোথাও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্তদের মধ্যে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা। তবে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার ব্যবহার হচ্ছে অনেকটাই কম।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন। তাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের কথা উল্লেখ করে বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলছে, আপাতত এর চেয়ে বেশি হাই ফ্লো ব্যবহার করার পরিকল্পনা তাদের নেই।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৯৫০টি এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৬৫০টি। এছাড়া চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকাারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা আছে ২৬টিতে। সরকারি ৪৭টিসহ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে ১৭১টি। ৮০টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৫৬টি।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোববার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা কোথাও খালি ছিল না। আইসোলেশন ওয়ার্ডেও শয্যা খালি আছে হাতেগোনা কয়েকটি। হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি করানোর আগে বলে দেওয়া হচ্ছে, নরমাল বেড দিতে পারলেও আইসিইউ বেড কিংবা উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।

হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার মাধ্যমে রোগীদের ৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া যায়। আর করোনাভাইরাসে ভোগা বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই এখন উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দরকার হচ্ছে। চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, অনেক রোগীকে সঠিক সময়ে হাই ফ্লো দেওয়া গেলে আইসিইউর প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রয়োজন থাকলেও অনেক রোগীকে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া যাচ্ছে না।

চট্টগ্রামে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহার হচ্ছে মা ও শিশু হাসপাতালে। সেখানে ৩৩টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহার হচ্ছে। অথচ সরকারি দুই হাসপাতাল মিলিয়ে ব্যবহার হচ্ছে এর চেয়ে কম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এই মুহূর্তে ১৮টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দাবি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র ১৩টি। তবে তাদের হাতে আরও ১৩টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে, যেগুলো সচল হলেও ব্যবহার হয় না। অন্যদিকে চমেক হাসপাতালে ৪০টির মতো ন্যাজাল ক্যানোলা আছে, যেগুলো নষ্ট।

গত কয়েকদিনে চট্টগ্রামে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার প্রয়োজন হওয়া রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে ভোগান্তির কথা শোনা যাচ্ছে বেশ। চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ বলছেন, সরকারি দুই হাসপাতালে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ানো গেলে এই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে।

এক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখতে পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা যেমন আসছে, তেমনি সরকারি বড় দুই হাসপাতালের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নষ্ট থাকা ৪০টি মেশিন ঠিক করানোর কথাও বলছেন কেউ কেউ। কিছুদিন আগে একইভাবে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে টেকনিশিয়ান নিয়ে গিয়ে সাতটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা মেরামত করিয়েছিল চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেখানে মা ও শিশু হাসপাতালে ৩৩টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা ব্যবহার করা যাচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর জেনারেল হাসপাতালে একই পরিমাণ হাই ফ্লো ব্যবহার করা গেলে এই সংকট মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়ে যেত। কারণ সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন পেলেও অনেক রোগী ভাল হয়ে যেত। না পেলে সেটা খারাপের দিকে যায়। এটা করা গেলে আইসিইউর ওপর চাপ কমবে। এখন আইসিইউ বাড়ানোর চেয়ে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলার ব্যবহার বাড়ানো সহজ।’

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই মুহূর্তে ১৮টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা যথেষ্ট নয় জানিয়ে বিকল্প হিসেবে অক্সিজেন সাশ্রয়ী বাইপেস মেশিন সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়েও ভাবছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তবে তাদের হাতে থাকা ৪০টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা মেরামত করিয়ে ব্যবহার করার উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে না— এমন প্রশ্নের উত্তরে এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক আফতাবুল ইসলাম।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়ক ও জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাই ফ্লো বেশি ব্যবহার করলে অক্সিজেনের প্রেসার ফল করে। তখন অন্য যারা নরমাল অক্সিজেন নিচ্ছে, তাদেরও অসুবিধা হয়। আমাদের এখন ১৩টি মেশিন ব্যবহার হচ্ছে এগুলো যথেষ্ট। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনেও হাই ফ্লোর ব্যবহার কমিয়ে বাইপাস মেশিন ব্যবহার বাড়াতে বলা হয়েছে।’

এদিকে চমেক হাসপাতালের অক্সিজেন সরবরাহ সচল রাখতে বিকল্প অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তাদের সর্বশেষ কোভিড-১৯ কোর কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও হাসপাতালটির নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!