২ বছরে ৬০ হাজার শিশুর জন্ম, অপেক্ষায় ৩০ হাজার গর্ভবতী নারী

রোহিঙ্গা ক্যাম্প

২০১২ সালে মিয়ানমারে থাকতে স্বামীকে হারান আয়েশা। স্বামী হারানোর পর দুবার ধর্ষিত হন তিনি। ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে হামলা চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সে সময় তারা ধর্ষণ করে আয়েশাকে। পরে আবার ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে ধর্ষণ করেন সন্তানদের সামনে। ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর আয়েশা টের পান তিনি অন্তঃসত্ত্বা। লোকলজ্জা আর কলঙ্কের ভয়ে গ্রামের কাউকে কিছু বলতে পারছিলেন না।

তবে রাখাইন রাজ্যের সবাই জানে, মিলিটারিরা যখন আক্রমণ করে, ঘরে ঘরে গিয়ে নারীদের ধর্ষণও করে। যুগ যুগ ধরেই যেকোনো যুদ্ধে বা হামলায় ভয়ংকর এই নির্যাতনের শিকার হন নারী। তাই কিছুদিনের মধ্যেই আয়েশার গর্ভধারণের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন গ্রামবাসী।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: ইউএনএফপিএ
কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: ইউএনএফপিএ

নিরুপায় আয়েশা বিষয়টি গোপন রাখতে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে যান ভ্রূণ নষ্ট করতে। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও বেঁচে থাকে তাঁর পেটের সন্তান। পরে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন তিনি। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় হয় তার। এখানে এসেও পেটের সন্তান নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। সন্তান নষ্ট করতে গেলে নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কা ছিল তাঁর। পাঁচ সন্তানের কথা ভেবে জীবনের এই ঝুঁকি নেননি তিনি।

গত বছরের ২৬ জানুয়ারি জন্ম নেয় আয়েশার ছেলে ফায়াজ। মায়ের ওপর ভয়ংকর মানবিক ও শারীরিক কষ্ট গেলেও ফায়াজ সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সুস্থ সবল হয়ে জন্ম নেয়। ফায়াজের জন্মের পর আয়েশার পরিবার দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এমনকি শরণার্থী শিবিরের মানুষেরাও। আয়েশার বড় দুই মেয়ে ফায়াজকে ভাই বলে মানতে চায় না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আয়েশা তো পরিস্থিতির শিকার। ওর কী করার ছিল?

২ বছরে ৬০ হাজার শিশুর জন্ম, অপেক্ষায় ৩০ হাজার গর্ভবতী নারী 1
ছবি: ইউএনএফপিএ

অবশেষে দুই মেয়েকে নিজের কষ্টের কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন আয়েশা। মায়ের কষ্ট তো মেয়েরাই বুঝতে পারে। তারা মেনে নিয়েছে ভাইকে। আয়েশা বলেন, মেয়েরা ওর সঙ্গে খুব খেলে। হয়তো ভাইকে ওরা ভালোবেসে ফেলেছে।

সরকারি হিসেবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রায় দুই বছরে মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে কক্সবাজারে পালিয়ে এসেছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। গণহত্যা, ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা, নারীদের ধর্ষণসহ ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয় ওই রোহিঙ্গারা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কতজন আসলে আয়েশার মতো, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।

এরপর নয় মাস পার হলে তাদের অনেকেরই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে। কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার প্রথম তিন মাসেই ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারী শনাক্ত করা হয়।

রোহিঙ্গা সমস্যার শুরুতে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১৩০টি শিশু জন্ম নেবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুসারে এ সংখ্যা শতাধিক হবে না। জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশন ও ইউএনএইচসিআর এর হিসেবে টেকনাফ ও উখিয়া এই দুই উপজেলার ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ৯২টি শিশু। এই হারে প্রতিমাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন মুখ যোগ হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার।

নাগরিকত্ব, এমনকি জীবনের নিশ্চয়তা না থাকলেও ২০১৭ সালে এদেশে আসা বেশিরভাগ দম্পতি এরই মধ্যে হয়েছেন অন্তত এক সন্তানের বাবা-মা। অনেকেই আছেন হওয়ার অপেক্ষায়। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত এ ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিয়েছে ৬০ হাজারেরও বেশি শিশু। আগামী ১০ মাসের মধ্যে জন্ম নেওয়ার অপেক্ষায় আছে আরো প্রায় ৩০ হাজার শিশু।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন আশঙ্কা করছে, অস্থায়ী ক্যাম্পে জন্ম হতে যাওয়া এই নবজাতকদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন রোগ ও পুষ্টিহীনতার ফলে মারা যেতে পারে। এই বিরাট সংখ্যক শিশুর জন্ম প্রক্রিয়া, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি মোকাবেলা করা বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষের জন্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: ইউএনএফপিএ
কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবি: ইউএনএফপিএ

দুই বছরে সরকারি উদ্যোগ
কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সর্বশেষ (১ জুলাই ২০১৯) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পর্যন্ত দুই লাখ এক হাজার ৫৭২ জন গর্ভবর্তী নারী সেবা নিয়েছেন। প্রসব সেবা নিয়েছেন ৫ হাজার ৫৭০ জন নারী, প্রসব পরবর্তী সেবা নিয়েছেন ৩৩ হাজার ৫৫৫ জন নারী, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছেন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯০ জন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৪ হাজার ৩৩৮ জন গর্ভবতী নারী শনাক্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এ পর্যন্ত ২৬৬ জন রোহিঙ্গা এইডস আক্রান্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারিভাবে ৫০টি ও বেসরকারিভাবে ১৬৯টিসহ মোট ২১৯টি মেডিকেল স্থাপন করা হয়েছে সরকারিভাবে। এছাড়া ক্যাম্প এলাকাসহ সংলগ্ন স্থানে মোট সাতটি ফিল্ড হাসপাতাল এবং ১৬২টি প্রাথমিক পরিচর্যা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তারমধ্যে ১০টি হাসপাতাল/স্বাস্থ্য কেন্দ্র ২৪ ঘন্টা সেবা প্রদান করছে। হাসপাতাল/স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মোট ৯৬৩টি নতুন আইপিডি শয্যা চালু করা হয়েছে। ক্যাম্পে পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ৪টি, রুরাল ডিসপেনসারি একটি, নিবন্ধিত এনজিও আটটি এবং সাতটি জরুরি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

জন্মহার যে কারণে বেশি
রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা ঐতিহ্যগতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধী। এ কারণে রোহিঙ্গাদের জন্মহার বেশি। তবে সরকারিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচি চালানোর পর চলতি বছর জন্মহার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। নারীদের ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ ও ইনজেকশন ছাড়াও তিন ও ১০ বছর মেয়াদী ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে।

শুরুতে খানিকটা অনাগ্রহ থাকলেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের তৎপরতায় পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে রোহিঙ্গারা। আইসিসিডিআরবির জরিপ অনুসারে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে শতকরা ৩৪.৭ ভাগ নারী-পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন’।

রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ওপর আরোপিত একটি অতিরিক্ত বোঝা বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট-ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান। এ বিষয়ে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৬-১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি ছিল না। এটি বাংলাদেশের উপর আরোপিত বোঝা। এই বোঝা বহন করার সামর্থ্য বাংলাদেশের নাই। এর ফলে দেশে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে।’

রোহিঙ্গা বিষয়ে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. নুরুল আলম নিজামী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবার পরিকল্পনা জোরদার করা হচ্ছে। যাতে রোহিঙ্গারা পরিকল্পিত পরিবার গড়তে পারে। বিতরণ করা হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী। সরকারি ও বেসরকারিভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে সবকিছু।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!