২৯ বছর আগে নিখোঁজ এই ছেলের আশায় পথ চেয়ে থাকে একটি পরিবার

সময়টা ১৯৯০ সাল। দরজায় কড়া নাড়ছিল এসএসসি পরীক্ষা। তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাশেম। ইংরেজি বিষয়ে তার দক্ষতা বড়দেরও হার মানায়। ছয় ভাইবোনের মাঝে তিনি পঞ্চম। প্রায় সকলেই পিঠাপিঠি। তবে দুই বছরের বড় বোন সুলতানা রাজিয়া হুদার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বেশি হাশেমের। বোনকে ছাড়া একদিনও থাকা হয় না তার। খুনসুটি আর ভালোবাসায় কেটে যায় সারাদিন।

কলেজে পড়া অবস্থায় বোন সুলতানা রাজিয়া হুদার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল পরিবারে। বিয়ের চার-পাঁচদিন আগে বাসায় বিয়ে প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার একপর্যায়ে হাশেম মাকে বললেন, ‌‘তোমরা আমার বোনকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো কেন! ও তো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পড়াশোনা শেষ করতে দাও।’

কথার পিঠে মা বেদুরা বেগম চৌধুরী মজা করেই বললেন, ‘তোমরা তো শুধু ঝগড়া করো৤ তাই ওকে (রাজিয়া) বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।’ মায়ের আকস্মিক এই কথা মানতে না পেরে হাশেম বলেন, ‘ওহ্ আমার জন্য বিয়ে দিয়ে দিচ্ছ! ওকে খুব বিয়ে দিয়ে দাও। আমি ঘর থেকে চলে যাচ্ছি।’

সেই যে হাশেম বেরিয়ে গেলেন আর ফিরে আসেননি। কেউ ভাবতেও পারেননি হাশেম এভাবে চলে যাবে। মায়ের এই ছোট্ট মজার ছলে বলা কথাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল আহমদ কবির চৌধুরীর পরিবারে।

নিখোঁজ হাশেম চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাট থানার উত্তর নালাপাড়া এলাকার করিম ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী আহমদ কবির চৌধুরীর চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে পঞ্চম৤

নালাপাড়ার বাসা থেকে ঠুনকো অভিমানে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হওয়া হাশেম আর ফিরে আসেননি। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত, প্রশাসন কোথাও বাদ যায়নি খোঁজাখুজি থেকে। কিন্তু খোঁজ মেলেনি হাশেমের। সেই ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে একে একে কেটে গেল ২৯টি বছর। খোঁজ মিললে এতদিনে হাশেমের বয়স হতো ৪৫ বছর।

জীবনের প্রয়োজনে আহমেদ কবির চৌধুরী ২০০৩ সালে সপরিবারে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকাতে। সেখান থেকেই পুরো পরিবার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি ছেলের সন্ধানে। কিন্তু ২৯ বছর আগে নিখোঁজ হওয়া হাশেম আজও বেঁচে আছেন কিনা কেউ জানেন না। তবুও বছরের পর বছর পত্রিকায় পাতায় হারিয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপনের ভিড়ে বাবা এখনও আশায় থাকেন তার ছেলে ফিরে আসবেন।

৮৭ বছর বয়সী বাবা আহমেদ কবির মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ‘ছেলে ফিরে আসবে।’ হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও তার প্রাণ পড়ে আছে বাংলাদেশে। ২৯ বছর ধরে ছেলেকে একবার দেখার জন্য কী আকুতি ও আর্তনাদ এই অসহায় বাবার! অন্তত চোখের দেখায় একবার ছেলেকে দেখার জন্য ২৯টি বছর অপেক্ষায় আছেন মৃত্যুপথযাত্রী বাবা। ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছেলের শোকে কাতর মা বেদুরা বেগম চৌধুরী ২০০৮ সালে পরপারে চলে যান।

বাবা আহমেদ কবির চৌধুরী কখনই ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু ছেলের খোঁজে দিশেহারা হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পীর-ফকির বাবার দরবারেও। তাদের কথা অনুযায়ী কত দিন কত রাত তিনি কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন তার হিসেব নেই। কখনও ঢাকা, কখনও রাঙামাটি, কখনও খুলনা আবার কখনও ঘন গভীর জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন ছেলেকে পাওয়ার আশায়। ফকিরবাবার কথা অনুযায়ী একবার হাটহাজারীর ভেতরের গভীর পাহাড়ে ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যান। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা নিখোঁজ হাশেমের ভাই ড. রেজা চৌধুরী, সফিউল আজিম চৌধুরী, সেলিম চৌধুরী, কাসেম চৌধুরী এবং বোন সুলতানা রাজিয়া চৌধুরী প্রতিনিয়ত আশায় বুক বেঁধে আছেন ভাইয়ের পথ চেয়ে। দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে বাবা আহমেদ কবির চৌধুরী প্রায়ই ফোন করে জানতে চান, ‘ছেলের কোনো খবর পাওয়া গেছে কিনা।’

অসহায় বাবার আকুতি সহ্য করতে না পেরে ২৪ আগস্ট মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী জিয়া হাবীব আহসান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হাশেমকে খুঁজে পেতে সকলের সাহায্য চান।

জিয়া হাবীব আহসান ও নিখোঁজ হাশেম সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো ভাই। জিয়া হাবীব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ধারণা সে বেঁচে আছে। কারণ হারানোর ২-৩ দিন পর বিজ্ঞপ্তি দেখে কুমিল্লা থেকে একজন জানিয়েছিল তাকে কুমিল্লায় দেখা গেছে। হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সে আর ফিরতে পারেনি। তবুও চাই ও (হাশেম) ফিরে আসুক। ফুফার কান্না আর নিতে পারি না। বুকটা ফেটে যায়। কী আকুতি, আর্তনাদ এই অসহায় বাবার! ছেলেকে পাবার আশায় এখনও কী প্রতীক্ষা!’

নিখোঁজ হাশেমের ছোট ভাই কাশেম চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভাইকে হারিয়ে আমার বাবা পাগল পাগল হয়ে গেছে। প্রায়ই আমাদের বলে তোরা আমার ছেলেকে ফোন করিস না কেন? তোরা আন্তরিক না, তাই ও বাড়ি ফিরছে না। আমার সাথে তো ওর (হাশেম) কথা হয়েছে। মা কিছুটা মানসিকভাবে শক্ত-সামর্থ্যবান ছিলেন। তবে বাবা খুব নরম মনের মানুষ। ভাইয়ের শোকে মা আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন আর বাবাও এখন মৃত্যুপথযাত্রী। আমার বিশ্বাস ভাইকে খুঁজে পেলে আমার বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাবা প্রায়ই বলতেন যুক্তরাষ্ট্রে এসে অনেক ভুল করেছি। তোরা আমার ছেলেকে খুঁজে আন।’

কাশেম আরও জানান, ‘আমরা কেউই ভালো নেই। সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজে পেতে আমাদের পরিবারের সবাই ব্যাকুল।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!