২৫০টি দোকান বানিয়ে ফুটপাত বেচে দিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, দোকানবাণিজ্য জামালখানেও

‘এগুলো তো বৈধ’— সাফাই মেয়র রেজাউলের

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে ও গাছ কেটে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণের ঘটনায় জনঅসন্তোষ তৈরি হওয়ার পর এখন এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের খেলা। মেয়র ও সাবেক প্রশাসকের এই ‘অভিযোগ—পাল্টা অভিযোগের’ খেলায় মাঝখান থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে ফুটপাত দখল ও গাছ কেটে দোকান বানানো দখলদাররা। অভিযোগ রয়েছে, ফুটপাতে দোকান বানানোর সুযোগ করে দিয়ে কিছু ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।

বায়েজিদের শেরশাহ, তারা গেট ও টেক্সটাইল এলাকায় ফুটপাতের ওপর প্রায় ২৫০টি দোকান বসানোর অনুমতি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। যদিও এর আগে চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে ফুটপাত দখলমুক্ত করেছিলেন। ওই সময় চসিকের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ফুটপাত দখলদারদের বিকল্প কর্মসংস্থান করার। এরপর ‘চসিকের আয় বাড়িয়ে বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য’ ফুটপাতেই দোকান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় চসিক।

দোকান বানানোর এমন কাণ্ডে যখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, দোকান নির্মাণের অনুমতি তিনি দেননি। ওই অনুমতি দিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।

তবে মেয়র রেজাউলের এই অভিযোগকে বানোয়াট ও মিথ্যা বলে দাবি করেছেন সাবেক প্রশাসক সুজন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘মেয়র যদি একটিমাত্র প্রমাণও দেখাতে পারেন যে আমি অনুমোদন দিয়েছি, তবে আপনাদের বলে রাখছি আমি রাজনীতিই ছেড়ে দেবো।’

সুজনের এমন চ্যালেঞ্জের পর এ বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এবার বললেন, ‘এগুলো তো বৈধ, এগুলো ফুটপাতের ওপর করা হচ্ছে না। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। ফুটপাতের জন্য ৫ ফিটের মত জায়গা রয়েছে। আর যারা দোকান করেছে তারা ফুটপাতের বাইরে গিয়ে দোকান করেছে।’

ফুটপাত দখল ও গাছ কেটে তৈরি করা ওইসব দোকানকে ‘বৈধ’ দাবি করে মেয়র রেজাউল বলেন, ‘কিছু মানুষ আপনাদের ভুল বোঝাচ্ছে। এটা ফুটপাতে না এবং এগুলো বৈধ দোকান।’

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।

তবে মেয়র ও সাবেক প্রশাসকের এমন পাল্টাপাল্টির মাঝখান দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন দোকান বানানো দখলদাররা। এদিকে দায়িত্বশীল জায়গা থেকেে প্রতিবার এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দিয়ে দায় সারার প্রবণতাকে ‘অপরিপক্কতা’ ও ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ কাজ বলে অভিহিত করেছেন সচেতন নাগরিকরা।

জানা গেছে, ফুটপাতের ওপর এই দোকানগুলোর প্রতিটি এক লাখ ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে পাঁচ বছরের চুক্তিতে নিয়েছেন দোকানিরা। চসিক শুধু জায়গা দিয়েছে, দোকান তৈরি করতে হবে দোকানিদের— এমন শর্তে ভাড়া দেওয়া হয় ফুটপাতগুলো।’

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে ২০০টি দোকানের কথা বলা থাকলেও বাস্তবে সেই সংখ্যাটা আরও বেশি।

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে।

বায়েজিদ, শেরশাহ্ ও টেক্সটাইল এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দোকান তৈরির কাজ শেষ, উঠানো হয়েছে মালামালও। আর কিছু দোকানের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ফুটপাতে থাকা গাছগুলোকে রাতে কেটে তার গোঁড়ালিতে এমনভাবে বালি ও সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা হয়েছে যে, কেউই বুঝতে পারবে না এখানে আগে সারি সারি গাছ ছিল।

এদিকে এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হলে গাছ কেটে দোকান বানানোর অভিযোগের সত্যতা জানতে বুধবার (১০ নভেম্বর) এলাকাগুলোতে যান মেয়র রেজাউল করিম।

স্থানীয়রা জানান, এ সময় মেয়রকে অর্ভ্যথনা জানাতে বেশ কিছু লোককে ‘বাসিন্দা’ সাজিয়ে জড়ো করা হয়। মেয়রকে তারা বুঝিয়েছেন— গাছ তো দূরে থাক, গাছের একটি ডালও কাটা হয়নি। যেভাবে চসিক দোকান করার অনুমতি দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই নির্মাণ করা হচ্ছে দোকান। অথচ এর আগে গাছ কাটাসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

তবে মেয়র আসার আগাম খবর পেয়ে টেক্সটাইল এলাকায় গাছ রেখে তৈরি করা অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়।

এদিকে বুধবার (১০ নভেম্বর) এলাকাগুলো পরিদর্শন শেষে মেয়র রেজাউল সাংবাদিকদের জানান, ফুটপাত রক্ষায় কঠোর মনিটরিং করা হবে। ফুটপাত যেন কেউ দখল করতে না পারে তার জন্য দেওয়া হবে রেলিং। মেয়রের এ ঘোষণায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বরাদ্দ পাওয়া দোকানিরা। এ সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দেখা যায় তাদের।

জানা গেছে, ফুটপাতে দোকান নির্মাণের বিরোধিতা করে ইতিমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে লিখিত চিঠি দিয়েছেন।

তারা বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির নামে ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ নেওয়ার পেছনে কিছু ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। অথচ এসব ফুটপাত দিয়ে গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানার হাজারও শ্রমিক চলাফেরা করেন। এ এলাকায় রয়েছে একাধিক গার্মেন্টস ও শিল্পকারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানের মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে ভারী যানবাহনও চলাচল করছে এ এলাকা দিয়ে। তার চেয়ে বড় সমস্যা হবে, ফুটপাত ব্যবহার থেকে বঞ্চিত হয়ে পথচারীরা রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন। শিল্প এলাকা হওয়ায় ভারী গাড়ি চলাচল হয়ে থাকে টেক্সটাইল এলাকায়। স্বাভাবিকভাবেই জনচলাচলে তৈরি হবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

বায়েজিদের স্থানীয় বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা লেয়াকত আলী ফুটপাতগুলোতে নিজের হাতেই লাগিয়েছিলেন অনেকগুলো গাছ। তার পুত্রসমতুল্য সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে দোকান বানানোর জন্য। ইট বালির আস্তরণ দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে মাটিও।

দুঃখ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘কাজ করার ক্ষমতা না থাকলে কে বলেছে ওনাদের চেয়ারে বসতে? অনুমোদন যেই দিক, এটা যে অবৈধ— সেটা তো একটা দুধের বাচ্চাও বুঝবে। দায়িত্বশীল নেতারা যদি একজন আরেকজনের প্রতি দোষ না চাপিয়ে আগে এই অবৈধ স্থাপনাগুলো বন্ধ করতেন, তাহলে ফুটপাতও দখল হতো না আর গাছগুলোও কাটা পড়তো না।’

জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর টেক্সটাইল মোড় এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় সিটি কর্পোরেশন। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি উচ্ছেদ করা স্থানে সিটি কর্পোরেশন ফের ফুটপাতে দোকান বরাদ্দের সিদ্ধান্ত দেয়। গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, উচ্ছেদকৃত টেক্সটাইল গেট, শেরশাহ, ও তারা গেট ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রশাসক যেসব সিদ্ধান্ত দেন, সেগুলো হল— চসিকের প্রকৌশল বিভাগ জায়গা চিহ্নিতকরণ, চিহ্নিত জায়গা এস্টেট শাখা থেকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। ভাড়া আদায় করা হবে। দোকান মালিকগণ তাদের নিজস্ব খরচে দোকান নির্মাণ করবেন।

সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, টেক্সটাইল গেট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নামে টেক্সটাইল মোড় থেকে চন্দ্রনগরমুখী সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে ৬৬টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে তারাগেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ও শেরশাহ রোড ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির ব্যানারে শেরশাহ সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে ১০০টি, তারা গেট সড়কের দুই পাশের ফুটপাতে ৯০টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। ১০-১১ ফুট ফুটপাতের পুরো অংশ জুড়েই গত একসপ্তাহে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা হয়েছে ৬৬টি পাকা দোকান। শুধুমাত্র টেক্সটাইলে অবৈধ দোকানগুলো থেকে দোকানপ্রতি এক লাখ ৮০ হাজার টাকা করে ৬৬টি দোকান বাবদ ১ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা সেলামি নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।

চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে দোকান বানিয়ে ফুটপাত দখল করে ফেলা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর জামালখানে দোকান বানিয়ে ফুটপাত দখল করে ফেলা হয়েছে।

জামালখানে কাউন্সিলরের ফুটপাত বাণিজ্য

চট্টগ্রাম নগরীতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আশকারায় ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে অনেক আগে থেকেই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের যোগসাজশে গড়ে তোলা হয় এসব স্থাপনা। নগরীর জামালখানে ফুটপাতের ওপরেই নির্মিত হয়েছে বেশকিছু দোকান। এসব দোকান তৈরি করা হয় যাত্রী ছাউনির নামে বরাদ্দ দেওয়া জায়গায়। শুধু তাই নয়, জামালখান মোড়ের পশ্চিম পাশে নালা ও ফুটপাতের ওপর স্লাব বসিয়ে তার ওপর তৈরি করা হয়েছে অ্যাকুয়ারিয়াম ও দোকান।

জানা গেছে, জামালখান মোড়ের দোকানগুলোর বিনিময়ে বড় অংকের টাকা পরিশোধ করেছে লিজ গ্রহীতারা। কিন্তু সেই টাকার খুব অল্পই সিটি করপোরেশনের ফান্ডে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বাকি টাকা ঢুকেছে কাউন্সিলর ও কর্পোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার পকেটে সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের পকেটে। কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের যোগসাজশে নালার ওপর দোকানগুলো চুক্তিভিত্তিক লিজ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামালখানের ফুটপাতে একুরিয়াম বসাতেই শুভাশীষ পোদ্দার নামে এক ব্যবসায়ীর বিভিন্ন খাতে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!