১৮ আঘাতে নিজের ক্ষোভ উড়াল খুনি, দেখে ফেলায় খুন শিশু রিফাতও
ঘটনা দুপুরে, সন্ধ্যায় ফিরে কিশোরী দেখে মা-ভাইয়ের লাশ
পুরো শরীরজুড়ে ধারালো ছুরির ১৮টি আঘাত। পেটের বামপাশে করা দুটি আঘাতের স্থানে শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে নাড়িভুঁড়ি। বাকি আঘাতগুলো দুই উরু, তলপেট আর হাতে। যা দেখে তদন্ত সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনির হাত থেকে জীবন বাঁচাতে প্রাণপণ লড়েছেন গুলনাহার বেগম (৩৩)। আর মায়ের হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলায় তার মাত্র দুই ফুট দূরত্বে পড়ে ছিল ৯ বছরের শিশু রিফাতের লাশও। মায়ের লাশ বাথরুমের ভেতরে, রিফাতের লাশটি দরজার সাথে লাগোয়া বেসিনে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। শিশু রিফাতের কণ্ঠনালী কেটে ফেলা হয়েছে। তার হাতেও ছুরির দুটি কাটা দাগ ছিল। যা থেকে অনুমান করা হচ্ছে খুনির ছুরির আঘাত ঠেকাতে চেয়েছিল রিফাত তার কচি দুই হাতে।
সোমবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় চান্দগাঁও ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের বিপরীতে রমজান আলী সেরেস্তাদারের বাড়ি এলাকার ভাড়াটিয়া গুলনাহার বেগম ও তার ছেলে রিফাতের লাশ সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট আলামত সংগ্রহ শেষে এমন চিত্রই উঠে আসে।
গুলনাহারের মেয়ে ময়ূরী আক্তার চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, বহদ্দারহাট খাজারোড়ের সিরাজ কসাইয়ের ছেলে ফারুকের সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ফারুকের সাথে গুলনাহার বেগমের পাতানো ভাই-বোনের সম্পর্ক ছিল। পেশায় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি ফারুক অবসর সময়ে গুলনাহারের বানানো নাস্তা বিক্রি করতো। লকডাউনের সময়েই একইভাবে বিরিয়ানি বিক্রি করছিল ফারুক। ফারুক বিভিন্ন সময়ে টাকার লেনদেন নিয়ে গুলনাহারকে হত্যার হুমকি দিতো।
ময়নাতদন্তের জন্য সোমবার (২৪ আগস্ট) রাত ১২টা ৩ মিনিটে মা-ছেলের লাশ তোলা হয় গাড়িতে। এরপর বাসায় প্রবেশ করে দেখা যায় একটা চুলোর পাশে একটা পাতিলে সিঙ্গাড়া-সমুচার উপাদান, আরেক পাতিলে তেল। যা দেখে পুলিশ বলছে, খুনটা হয়তো দুপুরের আগেই হয়েছে। কারণ যেসব নাস্তার উপকরণ ছিল, তা দুপুরের আগেই খাওয়া হয়। রাত ৮টায় যখন আজিম গ্রুপের গার্মেন্টস থেকে বাসায় ফিরে মা-ভাইয়ের লাশ দেখে ময়ূরী, তার ৮ থেকে ১০ ঘন্টা আগেই তারা খুন হন।
প্রতিবেশীরা জানান, গুলনাহারের স্বামী আরেক বিয়ে করে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে থাকেন। এই সংসারে তার এক মেয়ে দুই ছেলে ছিল। এক ছেলেকে তার বাবা সাথে নিয়ে গেলে তিনি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মেয়ে আজিম গ্রুপের পোশাক কারখানায় চাকরি পাওয়ার পর তিনি ঘরে নাস্তা বানাতেন। পাতানো ভাই ফারুক তা বিক্রি করতো। তবে তাদের ঝগড়া ছিল নিত্যসঙ্গী।
ঝগড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে মেয়ে ময়ূরী বলেন, ফারুক আমাদের ভালো চলা দেখতে পারতো না। আমাদেরকে হুমকি দিতো ইন্ডিয়ান টিভি সিরিয়াল সিআইডির মতো করে খুন করে লাশ প্যাকেট করে নোয়াখালী পাঠাই দেবো। ময়ূরীর নানার বাড়ি চকবাজার থানার ঘাসিয়াপাড়া এলাকায়। পিতার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলায়।
করোনা মহামারিতে চট্টগ্রাম নগরে অন্য সময়ের তুলনায় অপরাধ কম হলেও এক সাথে মা-ছেলে হত্যাকাণ্ডে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সব বাহিনী। নগর পুলিশ, নগর গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডি, পিবিআইয়ের পাশাপাশি র্যাবও নেমেছে মাঠে।
ঘটনার পর সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এসএম মোস্তাক আহমেদ খান, উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক, গোয়েন্দা দক্ষিণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন, র্যাবের মেজর মুশফিকুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার তারিক আজিজ, সিএমপির উত্তর জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার দেবদূত মজুমদার, ডিবির সহকারী কমিশনার জাহেদ মাহমুদসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এসএম মোস্তাক আহমেদ খান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত যেসব তথ্য উপাত্ত পেয়েছি, সবগুলোকে বিবেচনায় সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। আশা করছি খুনিকে দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো।
সিপি