১৪ বছরেও প্রথম বর্ষ না পেরুনো অছাত্রই চবি ছাত্রলীগের বড় পদে!

ছাত্রত্ব না থাকলেও বাসিন্দা আবাসিক হলের

১৪ বছর আগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে। তবে তার সহপাঠীরা পাঠ চুকিয়ে গেলেও চবির মায়া ছাড়তে পারেননি তিনি। এ মায়াতে আটকেই তিনি প্রথম বর্ষে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের ১৪টি বসন্ত। এর মধ্যে ছাত্রত্ব হারালেও হল ছাড়েননি তিনি। এখনও থাকেন চবির শাহ আমানত আবাসিক হলে। তার বিরুদ্ধে আছে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ। প্রথম বর্ষ পাশ না করা এই ‘আদু ভাই’ ঠিকই পাশ করেছেন রাজনীতির পাঠশালায়। চবি ছাত্রলীগের ১ নম্বর সহ-সভাপতি হয়েছেন তিনি।

এমন ‘গুণধর’ ব্যক্তিটির নাম আল আমিন রিমন। চবির সর্বশেষ কমিটিতে (২০১৫-২০১৯) ছিলেন সহ-সভাপতি। এবারও আছেন সেই একই পদে।

অছাত্রের পদ পাওয়ার এমন উদ্ভটকাণ্ডে তোলপাড় চলছে চবির রাজনীতিতে। অছাত্র, চাঁদাবাজকেই কেন ছাত্রলীগের এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে আবারও নেতা বানাতে হবে, তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন।

জানা গেছে, ২০০৮-০৯ সেশনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন আল আমিন রিমন। যার স্টুডেন্ট আইডি নম্বর ০৯৬০২১০৯। সে সময় প্রথমবার প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বসলেও মাত্র তিনটি বিষয়ে কোনো রকমে টেনেটুনে পাশ করেন এ দাপুটে ছাত্রনেতা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে এরপর টানা কয়েক বছর পরীক্ষাই দেননি তিনি। আসতেন না ক্লাসেও। তবে ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও নিয়মিত থাকতেন হলে এবং রাজনীতির মাঠে। এরপর যখন রিমনের রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ শেষ হয়, তখন তার ছাত্রত্ব বাতিল ঘোষণা করা হয়।

এরপর ঘুম ভাঙে রিমনের। আবারও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে এসে পুনরায় পরীক্ষা দিতে চান তিনি। এজন্য ভিসির বিশেষ অনুমতিও নিয়ে আসেন। কিন্তু সেবারও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। সেই বিশেষ অনুমতির মেয়াদও শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। অফিসিয়ালি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন। তবে রিমনকে ভালো ছাত্র হিসেবে না চিনলেও নেতা হিসেবে চিনতো উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সকলে। তাই এ বিভাগে তার বিষয়ে খোঁজখবর নিতেও তেমন বেগ পেতে হয়নি।

রিমনের ছাত্রত্ব হারানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ইকবাল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘রিমন ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিল। তবে ক্লাস তেমন করতো না। এমনিতে ডিপার্টমেন্টে আসতো। সে দীর্ঘদিন পরীক্ষা না দেওয়াতে তার ছাত্রত্ব চলে যায়, পরে ভিসির স্পেশাল অনুমতিতে আবারও ভর্তি হলেও পরীক্ষা দেয়নি। বর্তমানে সে আমাদের বিভাগের ছাত্র না।’

ছাত্রত্ব না থাকলেও হলে থাকার সুযোগ আছে কি-না এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বরতরা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ্ আমানত হলের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি রিমনের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে প্রতিবেদকের পীড়াপীড়িতে তিনি জানান, রিমন নাকি তার হলেই থাকেন না। ওর ছাত্রত্ব থাকা না থাকা এবং হলে থাকার বিষয়টি চবির একাডেমিক বিষয়। তাই এ বিষয়ে সামনাসামনি বসে কথা বলারও অনুরোধ করেন তিনি।

নির্মল কুমার সাহাকে রিমনের ছাত্রত্ব না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য প্রকাশ করতে বারণ করেন। পরে ব্যস্ততা দেখিয়ে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।

অধ্যাপক নির্মল কুমার সাহার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে যোগাযোগ করা হয় ড. ওমর ফারুকের সঙ্গে। তিনি চবি ভিসির ‘কাছের মানুষ’ হিসেবেই পরিচিত। রিমনের বিষয়ে ড. ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও উন্নয়ন বিষয়ক বিষয়গুলো দেখাশোনা করি। হলের বিষয়ে যে শিক্ষক দায়িত্বে আছেন, তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’

তবে ছাত্রত্ব না থাকার পর কারও হলে থাকার সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন এই শিক্ষক। আর নেতৃত্বে আসার বিষয়টি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জানান তিনি।

ছাত্রত্ব না থাকার পরও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে হলে থাকার একাধিক প্রমাণ রয়েছে বলে জানান অন্য হলের দায়িত্বে থাকা এক প্রভোস্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘নেতারা প্রভাব দেখিয়ে হলে সিট নিয়ে থাকে। এমনকি হাটহাজারীর স্থায়ী বাসিন্দার ছেলেরও হলে সিট আছে।’

এত অভিযোগের পরও কিভাবে রিমন ছাত্রলীগের শীর্ষপদে আসীন হন তা জানতে যোগাযোগ করা হয় চবি ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, চট্টগ্রামের এক উপমন্ত্রীর বেসরকারি এপিএসের ক্যাম্পাসভিত্তিক ‘ছোট ভাই’ রিমন। এই সম্পর্ককে পুঁজি করে পরপর দুবার কমিটিতে সহ-সভাপতির পদটি হাতিয়ে নেন রিমন।

অছাত্রদের পদে আনার কোনো সুযোগ আছে কিনা জানতে যোগাযোগ করা হয় চবি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল টিপুর সঙ্গে। দুজনই সুর মিলিয়ে বলেন, ‘ছাত্রত্ব না থাকলে কমিটিতে থাকার সুযোগ নেই। যদি রিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রকে জানানো হবে।’

অছাত্র হয়েও কিভাবে হলে থাকেন রিমন— এমন প্রশ্নের উত্তরে সভাপতি রুবেল বলেন, ‘হলগুলোতে নিয়মিত সিট বণ্টন হয় না, তাই এমন অবস্থা। যদি চবি প্রশাসন নিয়মিত হলগুলোতে সিট বণ্টন করত তবে এমন পরিস্থিতির তৈরি হতো না। ছাত্রত্ব না থাকলে হলে থাকারও সুযোগ নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে রিমনকে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও উত্তর দেননি।

চবিকেন্দ্রিক একটি সূত্র জানায়, চবির বগিভিত্তিক গ্রুপ সিএফসির নেতা রিমন। তিনি শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী। উপমন্ত্রীর এপিএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য তাকে কমিটির প্রথম সহ-সভাপতি বানানোর দেনদরবার চলছিল অনেকদিন ধরে। তাই চবির এই কমিটি প্রকাশ পেতে এত দেরি হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ২০২০ সালের ২২ জুন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিভাগের নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদাবাজি করতে যান রিমন। এ সময় রিমনসহ তার পাঁচ সহযোগী চাঁদা চেয়ে হামলা চালায় নির্মাণশ্রমিকদের ওপর। চাঁদা না দিলে ঠিকাদারকে গুলি করবে বলে হুমকি দেয় তারা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!