১২৬১ কোটি টাকায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন নদী খোঁড়ার প্রস্তাব দেখে পরিকল্পনা কমিশনই অবাক

২২ হাজার টাকার জরিপ খরচ উঠেছে ১ লাখ ২০ হাজার

কর্ণফুলীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন প্রধান নদী খনন ও দখলমুক্ত করতে প্রতি ঘনমিটারেই শুধু প্রকৌশল জরিপের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে। অথচ সমতলে একই ধরনের প্রকল্পে প্রতি ঘনমিটারে এই খরচ পড়ে মাত্র ২২ হাজার টাকা। নদীগুলো পাহাড়ি— শুধু এই যুক্তিতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষও (বিআইডব্লিউটিএ) প্রায় ছয় গুণ বেশি খরচ ধরেছে।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন প্রধান পাহাড়ি নদী হচ্ছে— কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী। এর মধ্যে ৩২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তি লুসাই পাহাড় থেকে। লুসাই থেকে নেমে কর্ণফুলী রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভুষণছড়া ইউনিয়নের ঠেগামুখ দিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশের সীমানায়। পরে কাপ্তাই হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে এসে মিশে গেছে বঙ্গোপসাগরে। কর্ণফুলীর মোহনাতেই চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান।

অন্যদিকে মিয়ানমারের আরাকানের পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া সাঙ্গু নদী বাংলাদেশে ঢুকেছে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে। এটি উত্তর দিকে বান্দরবানের থানচি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলা হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বান্দরবানের আলীকদম ও মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া মাতামুহুরী নদী উত্তর-পশ্চিম দিকে আলীকদম ও লামার দিকে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার দিকে।

এই তিন পাহাড়ি নদীর নাব্য উন্নয়ন ও পুনরুদ্ধারে মোট প্রকৌশল জরিপ কাজ হবে ৪১ দশমিক ৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাবিত প্রকল্প অনুযায়ী নদীগুলোর পাশাপাশি কর্ণফুলীর রাঙ্গামাটি-মারিশ্যা ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ নৌপথও খনন করা হবে।

পণ্য ও যাত্রীবাহী— তিন নদীতে এই দুই ধরনের নৌযানের চলাচলকে নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তাবিত এই খনন ও দখলমুক্ত করার প্রকল্পের জন্য মোট খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। প্রস্তাব অনুযায়ী ২০২২ সালের ১ জুলাই প্রকল্পটি শুরু হয়ে ২০২৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করা হবে।

প্রকল্পটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া; রাঙামাটির বরকল, জুরাছড়ি, কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটি সদর; বান্দরবানের আলীকদম, বান্দরবান সদর, লামা, রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি এবং কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালী উপজেলার বিভিন্ন অংশে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে।

এদিকে এমন মাত্রাতিরিক্ত খরচের এমন বহর দেখে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাব দেখে কমিশন মতামত দিয়েছে, যেহেতু অন্যান্য সমজাতীয় প্রকল্পে প্রকৌশল জরিপ ব্যয় অনেক কম, তাই বৃহত্তর চট্টগ্রামের তিন নদীর ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় বাড়ার কারণ ও ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা দরকার।

প্রকৌশল জরিপের খরচেই শুধু নয়, বেসরকারি ড্রেজার দিয়ে প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিংয়েও ধরা হয়েঠে প্রায় দ্বিগুণ ব্যয়। বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার ড্রেজিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫০ টাকা। অথচ চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে এই ব্যয় ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। একইভাবে মাটির ডাইক নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ১২০ টাকা। অথচ চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে এই ব্যয় ৭০ থেকে ৮০ টাকা।

প্রস্তাবিত প্রকল্পে ২ হাজার ১৩০ কিলোমিটার হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদীগুলো পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত— এমন যুক্তি তুলে ধরে বলছে, অন্যান্য নৌপথের সঙ্গে এই তিন নদীর তুলনা করলে হবে না। পাহাড়ি নদী হওয়ায় এখানে প্রকৌশল জরিপ কাজ যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি আছে শঙ্কাও। দুর্গম এলাকায় নৌপথ খনন ও প্রকৌশল জরিপ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কঠিন। এছাড়া সাঙ্গুর মতো নদীতে অনেক ড্রেজিং জাহাজ যেতেও পারবে না। এতে বিকল্প পথ অবলম্বন করতে হবে। সবমিলিয়ে এজন্যই বাড়তি খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে বাড়তি খরচের অস্বাভাবিক বহর দেখে এ নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকৌশল জরিপ, ড্রেজিং ছাড়াও প্রস্তাবিত আরও অনেক ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে তোলা হয়েছে সন্দেহ। এর মধ্যে রয়েছে—পরামর্শক খাতের অফিস ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, প্রিন্টার-কম্পিউটার সামগ্রী ও প্লটের ভাড়া, চেয়ার-টেবিল ও এসি কেনা, হোটেল ভাড়া ও ট্রান্সপোর্ট খাতে ব্যয় বরাদ্দ প্রস্তাবের যৌক্তিকতাসহ আরও নানা খাত।

বিআইডব্লিউটিএ নদীখননের এই প্রকল্পে অস্বাভাবিক পরিমাণে কম্পিউটার সামগ্রী কেনার প্রস্তাব রেখেছে। এর যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। নদীখনন প্রকল্পের আওতায় ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে ২০টি কম্পিউটার (১০টি কম্পিউটার ও ১০টি ল্যাপটপ), ১৪টি প্রিন্টার (প্রিন্টার ১০টি ও ই-প্রিন্টার চারটি), চারটি ফটোকপিয়ার, চারটি স্ক্যানার, ছয়টি ফ্যাক্স কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ প্রকল্পের জন্য একটি জিপ, দুটি পিকআপ ও পাঁচটি মোটরসাইকেল কেনারও প্রস্তাব দিলেও পরিকল্পনা কমিশন কেবলমাত্র একটি জিপ কেনার জন্য বলে দিয়েছে।

এছাড়া পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, পরামর্শকদের বেতন-ভাতা ও জনমাস বাবদ বরাদ্দও যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!