১২০ বিষধর সাপ পুষছে চট্টগ্রাম মেডিকেল, তৈরি হবে সাপে কাটার ওষুধ

বছরে সাপে কাটার ওষুধে যায় ১০ কোটি টাকা

মনোসেলেট কোবরা, বিনোসেলেট কোবরা, বানডেড ক্রাইট, ডব্লিউএলপি ভাইপার, এসটিপি ভাইপার, রাসেল’স ভাইপার, জি ব্ল্যাক ক্রাইট, কমন ক্রাইট, লাল গলার কিলব্ল্যাক— এগুলো একেকটি বিষধর সাপের নাম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের পুরোনো একাডেমিক ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে সাপগুলো পোষা হচ্ছে। সেখানে রয়েছে ৯ প্রজাতির ১২০টি সাপ।

ঢাকনাযুক্ত প্লাস্টিকের বড় বড় বাক্সে রাখা সাপগুলো। প্রতিটি বাক্সে একটি করে সাপ। কাছাকাছি যেতেই ফণা তোলে সাপগুলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি কক্ষে রাখা হয়েছে সাপগুলো। প্রতিটি বাক্সে লেখা রয়েছে সাপগুলোর পরিচিতি। খাবার হিসেবে ইঁদুর, মুরগীর মাংস এবং সাপ দেওয়া হয় এসব সাপকে। সাপের খাবার হিসেবে সরবরাহের জন্য ওই কক্ষে কাচঘেরা জায়গায় ইঁদুর পালনও করা হচ্ছে।

সাপে কাটার ওষুধ উদ্ভাবনে ৮ কোটি টাকা
২০২২ সালের মধ্যে দেশেই সাপে কাটার প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির লক্ষ্যে পোষা হচ্ছে এসব সাপ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মার্চে দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রকল্পটি শুরু হয়। এই প্রকল্পে যুক্ত আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মেডিসিন বিভাগ, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং জার্মানির গ্যাটে বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে ওষুধ নিয়ে গবেষণা। ছবি: দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে ওষুধ নিয়ে গবেষণা। ছবি: দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।

বছরে সাপে কাটার ওষুধে যায় ১০ কোটি টাকা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। তাদের মধ্যে মারা যান ৬ হাজার। চিকিৎসকদের মতে, সাপে কাটলে মানুষের শরীরে তিন ধরনের প্রভাব পড়ে। সেগুলো হচ্ছে হেমোটক্সিন বা রক্ত দূষণ, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশি অকার্যকর হয়ে যাওয়া এবং নিউরোটক্সিন বা মস্তিষ্ক অকার্যকর হয়ে যাওয়া।

সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতিবছর ১০ কোটি টাকার অ্যান্টিভেনম আমদানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সাপে কাটার পর যে অ্যান্টিভেনম ব্যবহৃত হয়, সেটি আসে ভারত থেকে। ভারতের ছয়টি প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম তৈরি করে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অ্যান্টিভেনম তৈরি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে শুধু একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দেশে অ্যান্টিভেনম বিপণন করে। তাদের এক ভায়াল (১০ এমএল) অ্যান্টিভেনমের দাম প্রায় এক হাজার টাকা। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনমের চাহিদা রয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ চলছে। এটি সম্ভব হলে অ্যান্টিভেনমের দাম অর্ধেকে নেমে আসবে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাপে কাটা একজন রোগীকে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী অ্যান্টিভেনম দিতে হয়। অনেক সময় একজন রোগীকে আট থেকে ১০ ভায়াল (১ ভায়াল=১০ এমএল) অ্যান্টিভেনমও দিতে হয়। প্রতিবছর সরকারিভাবে চাহিদার ভিত্তিতে প্রত্যেক বিভাগীয় হাসপাতালে ৫০০ ভায়াল করে, প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল এবং প্রত্যেক সদর হাসপাতালে ৫০ ভায়াল করে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়।

কালকেউটের কামড়ে মানুষ মরে বেশি
নিজের একটি গবেষণায় উদ্ধৃতি দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান জানান, বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এদের মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর। যার ১২ প্রজাতির অবস্থান সাগরে। বাকিগুলো গহীন জঙ্গলে এবং লোকালয়ে বসবাস করে। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা পড়ে কালকেউটের কামড়ে।

তিনি বলেন, ‘ভারতে গোখরো, কেউটে, চন্দ্রবোড়া ও স-স্কেলড ভাইপার— এই চার ধরনের সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করে প্রতিষেধক তৈরি করা হয়। তবে কেউটে সাপ ভারতে আছে এক প্রজাতির, বাংলাদেশে একাধিক প্রজাতির কেউটে সাপ আছে। আবার চন্দ্রবোড়া সাপ ভারতে বেশি হলেও বাংলাদেশে কম, আর স-স্কেলড ভাইপার বাংলাদেশে তেমন নেই, কিন্তু ভারতে রয়েছে। যে ধরনের গোখরো ভারতে পাওয়া যায়, সে ধরনের গোখরো বাংলাদেশে নেই।’

ড. ফরিদ বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে রাজশাহীতে একটি এলাকায় একই প্রজাতির সাপে কাটার কারণে ২০ জন মানুষ মারা গেছে। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি কারণ অ্যান্টিভেনম যথাযথ কাজ না করা। অঞ্চলভেদে সাপ যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি বিষের মাত্রায় তারতম্য থাকে। তাই প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নিশ্চিতের জন্য স্থানীয় সাপের বিষ দিয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।’

যেভাবে এগোচ্ছে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ
বর্তমানে কিছু সাপ থেকে নিয়মিত বিষ সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ১০ প্রজাতির সাপ থেকে বিষ সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে। নয় প্রজাতির সাপ এরই মধ্যে লালন-পালন করা হচ্ছে। সংগৃহীত বিষগুলো শ্রেণিকরণের জন্য রাজশাহী ও জার্মানির একটি ল্যাবে পাঠানো হচ্ছে।

পাঁচটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রথম প্যাকেজের কাজগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে সাপগুলো সংগ্রহ ও সেগুলো লালন-পালন এবং পরিচর্যা। দ্বিতীয় প্যাকেজে হবে সাপ থেকে বিষ সংগ্রহ এবং সংগৃহীত বিষগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা।

তৃতীয় প্যাকেজে বিষগুলো দিয়ে একটি মডেল তৈরি করা হবে। অ্যান্টিভেনমগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী মডেলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। চতুর্থ প্যাকেজে তৈরিরকৃত অ্যান্টিভেনমগুলো বিভিন্ন প্রাণির শরীরে প্রয়োগ করে অ্যান্টিভেনমগুলোর কার্যকারিতা দেখা হবে। এরপর পাইলট পদ্ধতির মাধ্যমে সাপে কাটা রোগীকে শরীরে দেওয়া হবে। পঞ্চম প্যাকেজে বাণিজ্যিকভাবে অ্যান্টিভেনমগুলো তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!