১১ কিশোরের লাশ সামনে রেখে চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্বজনদের আর্তচিৎকার

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‍ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) ভেতরে আর্ত চিৎকার— ‘ও পুত আরে ছাড়ি কই গেলি?’ এরকম কান্নাভরা আওয়াজ কানে বাজছে দূর থেকেও।

শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের মিরসরাই খৈয়াছড়া এলাকায় মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারানো ও আহত স্বজনদের কান্নায় ওসিসির বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। অপেক্ষা সবার। নিহতদের লাশ মেডিকেলে নিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।

গাড়িতে থাকা সবাই ছিলেন এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থী। কয়েকজন এইচএসসি পরীক্ষার্থীও ছিলেন। তাদের সকলেই আরএন্ডজে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। কেউ কেউ ছিলেন কোচিং সেন্টারের শিক্ষক।

ওসিসির ভিতরে নিহত ও আহত স্বজনদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাজিদ। তিনিও আরএন্ডজে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। তিনি বলেনন, ‘আমি ট্যুরে যাইনি বাড়িতে মেহমান আসবে তাই। আমি না গেলেও সকালে এসে আমি আমার বন্ধুদের বিদায় জানিয়েছিলাম।’

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার এস নজু মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল হিশাম (১৬)। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে তার পরীক্ষা শুরুর কথা। পরীক্ষা দিয়েই কানাডায় মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা ছিল ইশামের। ইশামের বাবা ছোটবেলাতেই মারা যান। তার নানার বাড়ির সবাই কানাডাপ্রবাসী। কানাডা যাওয়ার চেয়ে তার আরো বড় ইচ্ছে ছিল সে ক্রিকেটার হবে। পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় প্রাকটিস করবে।

হিশামের বাবা ছোটবেলা মারা যাওয়াতে চাচা মানিকের কাছে বড় হচ্ছিলেন। ওসিসির বারান্দায় চেয়ারে বাসা চাচা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্তও জানেন না তার ভাতিজা মারা গেছেন। তাকে বোঝানো হয়েছে তার ভাতিজা হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। ‘ও পুত কই তুই’ বলে আহাজারি করছিলেন হিশামের চাচা মানিক।

হিশামের মতো নিহত মারুফেরও এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল।

শুক্রবার (২৯ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে খৈয়াছড়া এলাকায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে সাতজন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের যাত্রীদের মধ্যে নিহত ১১ জনের মধ্যে নয়জনের পরিচয় মিলেছে। এর মধ্যে কোচিং সেন্টারের চার শিক্ষক জিসান, সজীব, রাকিব এবং রেদোয়ান। এছাড়া নিহতদের মধ্যে রয়েছে কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী হিশাম, আয়াত, মারুফ, তাসফির, হাসান। এদের সকলের বাড়িই চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আমান বাজার খন্দকিয়ায়।

আহত ছয়জন হলেন— মাইক্রোবাসের হেলপার তৌকিদ ইবনে শাওন (২০), একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মাহিম (১৮), তানভীর হাসান হৃদয় (১৮), মো. ইমন (১৯), এসএসসি পরীক্ষার্থী তছমির পাবেল (১৬) ও মো. সৈকত (১৮)।

হিশামের বন্ধু সাজিদ জানায়, কোরবানির ঈদের পর এই কোচিং ট্যুরের পরিকল্পনা হয় আগেই। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক শুক্রবার (২৯ জুলাই) কোচিং থেকে তারা মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্নায় যায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির ভেতরের রুমে বিলাপ করছিলেন তানভীর হাসান হৃদয়ের মা লাকী আক্তার। তিনি এখনও জানেন না তার ছেলে ২৮ নং ওয়ার্ডে ভর্তি। হৃদয় উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তারা এক ভাই ও এক বোন। তার মা বার বার বলছেন, ‘আমার ছেলেকে তোমরা এনে দাও।’

নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা মো. হামিদ ও ভাইকেও আহাজারি করতে দেখা যায় ওসিসিতে। তারা বসে আছেন লাশ কখন মেডিকেলে আসবে।

শিক্ষক রাকিবের মা পারভিন বেগম বিকেল চারটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আসেন। তিনি খুঁজছিলেন তার ছেলে রাকিবকে। রাকিবসহ আরো কয়েকজন এই কোচিং সেন্টারটি চালাতেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুস শুক্কুর হাসপাতালের সামনে মূর্ছা যাচ্ছিলেন বারবার। তার ছেলে আয়াতকে খুঁজছিলেন তিনি। আয়াতও ওই মাইক্রোবাসে ছিল। আয়াতের বন্ধু নাদিম জানায়, আয়াত পরীক্ষা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির জন্য ঢাকায় থেকে কোচিং করতে চেয়েছিল। আয়াতের ইচ্ছে ছিল সে ম্যাজিস্ট্রেট হবে।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!