১০ টাকায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে জরায়ু পরীক্ষা, হয় গর্ভবতীদের রুটিন চেকআপও

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি এবং প্রসূতি ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে নারীদের জরায়ুর মুখের ভায়া ও পাপস পরীক্ষা করা হয় মাত্র ১০ টাকায়। এছাড়া ১০ টাকায় টিকিট কেটে নারীদের অন্যান্য রোগের চিকিৎসা মেলে এখানে। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ এর বেশি রোগী আসেন চিকিৎসা নিতে। কোনও কোনও দিন এ সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। এখানে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও গর্ভবর্তীরাও নিয়মিত চেকআপ করাতে পারেন।

অধিকাংশ নারী জানেন না তার কী সমস্যা হচ্ছে। এভাবে অনেক সময় চলে যায়। যখন ডাক্তারের কাছে যায় তখন দেরি হয়ে যায়। এখানে অল্প টাকায় নিয়মিত চেকআপ বা চিকিৎসা করানোর সুযোগ রয়েছে। তাই অল্পতেই চিকিৎসা করানোর কথা বলেন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।

ভায়া (Visual Inspection with Acetic acid বা VIA) টেস্ট বা ভায়া পরীক্ষা হচ্ছে জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের একটি সাধারণ পদ্ধতি। জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অন্যান্য পরীক্ষাগুলোর মধ্যে ভায়া পরীক্ষা উল্লেখ্যযোগ্য। জরায়ু মুখের ক্যান্সারে সাধারণত বিবাহিত নারীরা আক্রান্ত হন। এছাড়া আমাদের দেশের আবহাওয়ার প্রভাব, কম বয়সে বিয়ে এবং ৩০ বছরের পর থেকে জরায়ু মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বছরে একবার হলেও ভায়া ও পাপস পরীক্ষা করানো উচিত বলে জানান বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।

গাইনি ও প্রসূতি বহির্বিভাগে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখানে আবাসিক সার্জন একজন, মেডিকেল অফিসার তিনজন, স্টাফ ইনচার্জসহ নার্স তিনজন এবং আয়া, ক্লিনার ও এলএমএস স্টাফ নিয়েই কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

বহির্বিভাগে সাধারণত নারীরা লিকুইরিয়া বা সাদা স্রাবজনিত সংক্রমণ, ভাজাইনাল ইনফেকশন, জরায়ু টিউমার, ফ্রাইব্রোয়েড টিউমার, ক্যান্সার সারভিক্যাল স্কিনিং, প্রল্যাপ্স ও ফিস্টুলাজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে আসেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল রেফারেল হাসপাতাল, তাই জটিল গর্ভবতী রোগীরাও এখানে আসেন বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল থেকে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগীরা টিকিট কেটে অপেক্ষা করছেন। তারপর মেডিকেল অফিসারের কাছে গিয়ে রোগের বর্ণনা দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখানে কথা হয় চট্টগ্রাম নগরীর রাহাত্তারপুল এলাকার বাসিন্দা রিতা আকতারের সঙ্গে। তার স্বামী দিনমজুর। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। মাত্র ১০ টাকায় টিকিট কেটে তিনি গাইনি ও প্রসূতি বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখিয়েছেন। অল্প টাকায় ডাক্তার দেখাতে পেরে খুশি রিতা বলেন, ‘মাত্র ১০ টাকায় টিকিট কেটে বড় ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। বাইরে চেম্বারে গেলে আমার ১ হাজার টাকা ফিস দিতে হতো। আমার স্বামী দিনমজুর, এত টাকা দিয়ে বাইরে দেখানো সম্ভব না।’

গাইনি ও প্রসূতি বহির্বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. জাকিয়া মমতাজ বলেন, ‘গাইনি সমস্যা হলে সেটা নিয়ে লুকোচুরি না করে ডাক্তারকে বলা উচিত। একইসঙ্গে সমস্যা সম্পর্কে জেনে রাখা দরকার। কিন্তু লজ্জার কারণে নারীরা এটা নিয়ে মুখ খুলতে চান না। অসুখ পুষে রেখে যখন ডাক্তারের কাছে আসেন তখন অনেক সময় চলে যায়। অধিকাংশ নারীই জানেন না যে, তার সমস্যাটি আসলে কী।’

তিনি বলেন, ‘যোনিপথ দিয়ে সাদাস্রাব নির্গমন হওয়া নারীদের জন্য স্বাভাবিক। যোনিপথকে পরিষ্কার রাখতেই এই প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে। তবে ছত্রাক সংক্রমণের কারণে এই সাদাস্রাবের পরিমাণ, রঙ, গন্ধ পরিবর্তিত হতে পারে। এটি মূলত অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্নতার জন্যই হতে পারে বেশি। এমনটি হলে চিকিৎসকের কাছে দ্রুত যেতে হবে। অনেক সময় এই অস্বাভাবিকতার কারণে হতে পারে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারও।’

রোগের ধরন সম্পর্কে বলতে গিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘পানি বেশি খাওয়া বা স্বাভাবিক কোনো কারণে অতিরিক্ত মূত্রত্যাগ হতে পারে। তবে যোনিপথে সংক্রমণ (ইউটিআই) এবং যৌনতার মাধ্যমে পরিবাহিত সংক্রমণও এর কারণ হতে পারে। এছাড়া পিরিয়ডের সময় রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক। তবে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তপাত হলে বা রক্তপাত অতিরিক্ত হলে সেটি চিন্তার কারণ। সংক্রমণ, তলপেটে জমা পাথর, সার্ভিক্যাল ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সারসহ আরও নানারকম কারণ থাকতে পারে এর পেছনে।’

ডা. জাকিয়া মমতাজ বলেন, ‘অন্যদিকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সময় ব্যথার কারণে হতে পারে এন্ড্রোমেট্রিয়োসিস, ভ্যাজিনিসমাস এবং ছত্রাক সংক্রমণের মতো ব্যাপারগুলো। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর রক্তপাত ঘটলে এর সঙ্গে সার্ভিক্যাল ক্যান্সার বা সার্ভিক্যাল পলিপ্সের সম্পর্ক থাকতে পারে। বিবাহিত অধিকাংশ নারীর সমস্যা ব্যাকপেইন। আবার গাইনোলজিক্যাল সমস্যায়ও ব্যাকপেইন হতে পারে। এর কারণে হতে পারে এন্ডোমেট্রিয়োসিস, ওভারিয়ান সিস্ট, নানাবিধ প্রদাহ ইত্যাদির মতো ব্যাপারগুলোও। এছাড়া মেনোপোজের সময় পার হলেও যদি আপনার রক্তপাত চালু থাকে, সেক্ষেত্রেও ব্যাপারটি গাইনি সমস্যার অন্তর্ভুক্ত হয়। যেকোনো একটি সমস্যা যদি থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।’

তবে সতর্কতার জন্য ডা. জাকিয়া বলেন, ‘আপনার যদি এ সমস্যাগুলোর কোনটাই না থাকে, তবুও ২৫ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি ২-৩ বছরে একবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে সার্ভিক্যাল স্মেয়ার এবং এইচপিভি পরীক্ষা করা উচিত। নিয়মিত পরীক্ষা করলে অস্বাভাবিক কোষকে শনাক্ত করা এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সহজ হয়ে যায়। এছাড়া ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসাউন্ড টেস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে ওভারিয়ান ক্যান্সার সম্পর্কে জানতে পারেন।’

রোগীদের সেবা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে গাইনি রোগীদের সেবা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। রোগীদের রোগ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করছি। চট্টগ্রাম মেডিকেলের মতো বড় চিকিৎসাকেন্দ্রে এসে নারীরা চাইলে সহজেই গাইনি ও প্রসবপূর্ব জটিলতা চিকিৎসা নিতে পারেন।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!