১০৮টি বিলাসবহুল গাড়ি চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলামে তুলতে আর কোনো বাধা নেই। সম্প্রতি গাড়িগুলোর ক্লিয়ারিং পারমিট (সিপি) দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কাস্টমসের আইন অনুসারে কোনো গাড়ি উৎপাদনের ৫ বছরের বেশি হলে নিলাম অথবা বিক্রি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিয়ারিং পারমিট নিতে হয়। এর আগে এই পারমিট না থাকায় নিলামে তোলা হলেও বিক্রি হয়নি গাড়িগুলো।
জানা যায়, গত বছরের ৪ নভেম্বর নিলামে তোলা হয়েছিল ১১২টি গাড়ি। সেইবার বিক্রি হয় তিনটি গাড়ি। তবে বাকিগুলোর মধ্যে এবার নিলামে তোলা হবে ১০৮টি গাড়ি। এসব গাড়ি ১০ বছর ধরে পড়ে আছে বন্দরে, যা উৎপাদন হয়েছে আরও কয়েক বছর আগে। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এসব গাড়ির সিপি পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কমিটির মাধ্যমের পুনরায় ইনভেন্ট্রি করে গাড়িগুলোর সিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে গত রমজান মাসেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবের সমন্বয়ে পুনরায় ইনভেন্ট্রি করে ক্লিয়ারিং পারিমিট (সিপি) দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফলে এই মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে এসব গাড়ি নিলামের তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস।
ব্যবসায়ীরা জানান, পুরাতন এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে গেলেও পড়তে হবে নতুন ঝামেলায়। এসব গাড়ির ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনও সহজ করার দাবি জানানো হয়।
আবার নিলামের ক্ষেত্রে সংযোজিত পণ্যের মূল্যের ৬০ শতাংশ কাভারেজ করার নিয়ম রয়েছে। বিলাসবহুল এসব গাড়ির ৬০ শতাংশ মূল্য কাভারেজ করতে গেলে ভ্যাটসহ ৪ কোটি টাকার গাড়িতে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্য দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো ধরনোর ঝামেলা ছাড়াই পুরাতন গাড়ি এক কোটি টাকার মধ্যেই বাংলাদেশে পাওয়া যায়। ফলে ৬০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের বিষয়টিও অবমুক্ত চান ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের গাড়ি আমদানিকারক ব্যবসায়ী রমনা কারের সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ সাদেক বলেন, ‘নিলামে তোলা গাড়িগুলোর মান এতই খারাপ যে, সেগুলো ক্রয় করে আমরা আর বিক্রি করতে পারবো না। ২০ বছর আগের উৎপাদন হওয়া গাড়িগুলো বিক্রি করা হচ্ছে এখন। ফলে সেগুলোর মডেলও অনেক ব্যাকডেটে হয়ে গেছে। এ ধরনের মডেলের প্রতি আমাদের দেশের ক্রেতাদের আগ্রহ নেই।’
আমদানিকারক মো. শামীম বক্স বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে থাকা গাড়িগুলো মূল্য ধরা হয়েছে সেই সময়ের নতুন গাড়ির দামে। এই দামে নতুন ব্র্যান্ডের নতুন উৎপাদিত গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম।’
চট্টগ্রাম কাস্টমসে নিলামকারী বিডার ইকবাল হোসেন বলেন, ‘বিলাসবহুল গাড়ি হলেও গাড়িগুলোর বর্তমান অবস্থান খুবই খারাপ। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় রোদের গরমে গাড়ির ভিতরের অনেক যন্ত্রাংশের নষ্ট হয়ে গেছে।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, ‘সহজে সিপি পাওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিটি পাঠানো হয়েছিল। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্ম সচিব এসে ইনভেন্ট্রি করে সিপি দিয়েছেন। এখন মন্ত্রণালয়ের কোনো বাধা রইলো না।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার আল আমিন বলেন, ‘সিপি পাওয়ায় এ মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে গাড়িগুলো নিলামে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। গতবারের নিলামেও ২০টি গাড়ির সিপি নেওয়া ছিল। বাকি গাড়িগুলোর সিপি এখন পাওয়া গেছে। রেঞ্জরোভার-মার্সিডিজ বেন্জ-বিএমডব্লিউসহ ১০৮টি বিলাসবহুল গাড়ি নিলামে বিক্রি করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। গত ৪ নভেম্বর কারনেট সুবিধায় আসা এসব গাড়ি ইলেকট্রনিক নিলামের (ই-অকশন) মাধ্যমে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় আমরা মাত্র তিনটি গাড়ি বিডারকে দিতে পেরেছি। তবে এবার তোলা হবে ১০৮ টি।’
মিৎসুবিসি ২৬টি, মার্সিডিজ বেন্জ ২৫টি, বিএমডব্লিউ ২৫টি, রেঞ্জরোভার ৭টি, ল্যান্ডক্রুজার ৭টি, একটি সিআরভি, লেক্সস ৬টি, ফোর্ড ৫টি, জাগুয়ার ৩টি, একটি দাইয়ু ও একটি হোন্ডাসহ নামিদামি ব্রান্ডের গাড়ি মিলিয়ে মোট ১০৮ টি গাড়ি রয়েছে।
এরমধ্যে ৪ কোটি টাকার রেঞ্জরোভার, ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার মিৎসুবিসি জিপ, ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার মার্সিডিজ বেন্জ জিপ, ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার জিপ, ২ কোটি ১২ লাখ টাকার লেক্সাস জিপ, ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার মিৎসুবিসি পাজেরো, ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার মার্সিডিজ, ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার রেঞ্জ রোভার, ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকার রেঞ্জ রোভার, ১ কোটি ৯২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ, ২ কোটি ২৯ লাখ টাকার টয়োটা, ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, ১ কোটি ৬২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ, ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ জিপ, ৩ কোটি ২০ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার জিপ, ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার, ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ, ২ কোটি ২৭ লাখ টাকার মিৎসুবিসি শোগান, ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার রেঞ্জরোভার, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ জিপ স্পোর্টস, ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকার লেক্সাস জিএস ৪৫০ এইচ, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ জিপ, ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকার মিৎসুবিসি শোগান, ২ কোটি ৮ লাখ টাকার মার্সিডিজসহ আরও নানা গাড়ি।
এক দশক আগে পর্যটক সুবিধার সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এসব গাড়ি এনেছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পর্যটকরা। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করায় গাড়িগুলো আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে খালাসের শর্ত আরোপ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পর্যটকরা গাড়িগুলো আর খালাস করেননি। ফলে দামি এই গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দরেই পড়ে থাকে।
আগ্রহী কেউ গাড়িগুলো দেখতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্টের ছবিসহ চট্টগ্রাম কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করে পাস নিয়ে দেখতে পারবেন। গাড়ি পরিদর্শনের তিনদিন আগে পাসের আবেদন করতে হবে। গাড়ি পরিদর্শনের সময় নির্ধারণ করবে কাস্টমস হাউস।
কাস্টমসের শর্ত অনুযায়ী, এই নিলামে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবেন। নিলামে অংশ নেওয়ার সময় শিডিউলের সঙ্গে ব্যক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এবং টিআইএন সার্টিফিকেটের কপি জমা দিতে হবে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সনদ অথবা টিআইএন সার্টিফিকেটের কপি জমা দিতে হবে।
টেন্ডার আবেদন খামবন্ধ অবস্থায় জমা দিতে হবে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট ও মোংলা কাস্টমস অফিসে রাখা টেন্ডার বাক্সে।
তবে এবার নিলাম কিভাবে হবে সেটি এখনও জানায়নি কাস্টমস হাউস। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ওয়েবসাইট www.chc.gov.bd অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের www.nbr.gov.bd ওয়েবসাইটের ই-অকশন লিংকে ঢুকে দরপত্র দাখিল করতে পারবে বিডাররা।
ডিজে