হেফাজত ভেঙে দুই টুকরো হচ্ছে, শেষ দেখতে চায় শফী অনুসারীরা

নেতৃত্বে আসছেন বাবুনগরী-কাশেমী

হেফাজতে ইসলামের রোববারের কাউন্সিল বন্ধ করা না হলে সদ্যপ্রয়াত আমির আল্লামা শফীর দুই হাজার খলিফাকে নিয়ে নতুন আরেকটি হেফাজতে ইসলাম গঠন করা হবে— এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে শফীর অনুসারীরা দাবি করেছেন, হেফাজতে ইসলামের নতুন কাউন্সিল ডাকার বৈধতা নেই।

রোববার (১৫ নভেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিল আহ্বান করেছেন বর্তমান মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারীরা। হেফাজতের এই সম্মেলনে অনুমিতভাবেই জুনায়েদ বাবুনগরী নতুন আমির ও নূর হোসাইন কাশেমী মহাসচিব হচ্ছেন বলে মনে করছেন দুই পক্ষের নেতারাই। এছাড়া অন্য কয়েকটি শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এতে মামুনুল হক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হারুন ইজহার সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পেতে পারেন।

বছরদুয়েক আগে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পদ থেকে পদত্যাগ করা মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী এই সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিকে পাশ কাটিয়ে পদত্যাগ করা একজনকে দিয়ে ডাকা এই সম্মেলনকে হেফাজত ভাঙার ‘কৌশলী চেষ্টা’ হিসেবে দেখছেন শফী অনুসারীরা। তবে বাবুনগরী সমর্থকরা বলছেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দলের মহাসচিব এই সম্মেলন ডেকেছেন।

এদিকে এখনও ‘ঐক্যবদ্ধ হেফাজত’ ধরে রাখতে আলাপ আলোচনা করে সমঝোতার চেষ্টা করছেন শফীর অনুসারীরা। তবে এই মুহূর্তে কর্তৃত্বে থাকা বাবুনগরীর সমর্থকরা এই ধরনের সমঝোতার বার্তাকে আমলে নিচ্ছেন না। এমনকি এই সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ায় বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ওয়াক্কাস, আব্দুল কুদ্দুস, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানকে ‘সরকারের দালাল’ বলে নাজেহালও করেছে বাবুনগরীর অনুসারীরা— এমনটাই দাবি আল্লামা শফীর অনুসারীদের।

হেফাজতের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রচার সম্পাদক আ ন ম আহমদ উল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যিনি এই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন, তিনি দুই বছর আগে পদত্যাগ করেছেন। এরপর আর তিনি হেফাজতে ফেরার ঘোষণাও দেননি। তিনি কিভাবে সম্মেলন ডাকেন? তাছাড়া এই সম্মেলনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির কেউ কিছু জানে না।’

হেফাজতের মূল শূরা কমিটিকে বাদ দিয়ে মনগড়া নতুন একটা শূরা কমিটি দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে হেফাজতকে জামায়াতীকরণের অপচেষ্টা চলছে— এমন কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হেফাজতের নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য বড় হুজুর বেঁচে থাকতেই ২০১৫ সালে ২০০ জনের একটি শূরা কমিটি করে দিয়েছেন। আজকে সেই শূরার নামগন্ধও নাই। যে ১৮ জনকে দিয়ে শুরা গঠন করা হয়েছে, তাদের ৩-৪ জন ছাড়া কেউ হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেই। এমনকি হেফাজতের প্রাথমিক সদস্যও নয় এমন লোককেও এই শূরায় রাখা হয়েছে।’

এই সম্মেলনকে ‘অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করে সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাইনুদ্দিন রুহী বলেন, ‘এটি কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদিত সম্মেলন নয়। মূলত জামায়াতি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গুটিকয়েক নেতা এই ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হোসাইন কাশেমী, মামুনুল হক, মুফতি হারুন ইজহার এসব কিছুর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মূল নেতা হিসেবে বাবুনগরীকে এসবের দায় নিতে হবে।’

মাওলানা রুহি বলেন, ‘মাওলানা বাবুনগরী ক্ষমতালোভী। ক্ষমতার জন্য যা করছে এখলাস দ্বীনদারীরর গন্ধও নাই। তারা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী হয়ে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। তারা জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। আমরা তাদের কাছে লোক পাঠিয়েছি। তারা সাড়া দেয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, না হলে সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।’

এই দ্বন্দ্বে কোনো পক্ষেই নেই এমন কয়েকজন আলেমও ঐক্যের চেষ্টা করে নাজেহাল হয়েছেন জানিয়ে হেফাজত নেতা আ ন ম আহমদ উল্লাহ বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে সম্মেলন করে হেফাজতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সম্মানিত অনেক আলেম চেষ্টা করেছেন। বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, হেফাজতের নায়েবে আমির মুফতি ওয়াক্কাস, আব্দুল কুদ্দুস, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান সাহেব এই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তাদের সরকারের দালাল বলে নাজেহাল করেছেন মামুনুল হক, মুফতি হারুন ইজহার, নূর হোসাইন কাশেমীরা।’

‘তবু আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। যদি দেখি তারা তাদের মত করে নেতৃত্ব নির্বাচন করে ফেলছে তখন আমরা আল্লামা শাহ আহমদ শফির ২০০০ খলিফাকে নিয়ে নতুন হেফাজতের কার্যক্রম ঘোষণা করবো’— বলেন আহমদ উল্লাহ।

এদিকে প্রথমে মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন— এমন কথা বললেও সমালোচনার মুখে সেই বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী নন সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। যারা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ডাক দিয়েছেন বলে লিখেছেন, তারা মনগড়া লিখেছেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মহাসচিব এই সম্মেলন ডেকেছেন। এতে সারা দেশ থেকে ৫০০ প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। সবার উপস্থিতিতে মুরুব্বিরা নেতা নির্বাচন করবেন।’

জামায়াতি এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই সম্মেলন আয়োজন করা হচ্ছে শফী অনুসারীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা ইসলামাবাদী বলেন, ‘এসব কথা যারা বলেন তারাই (ফয়জুল্লাহ-রুহি) জামায়াতের সাথে ২০ দলে আছেন। জামায়াতের এজেন্ডা উনারাই ভাল জানবেন।’

এদিকে এই মুহূর্তে জামায়াত নয়, ভারতকে নিয়েই বেশি ভাবা দরকার জরুরি— এমন মন্তব্য করে মুফতি হারুন ইজহার বলেন, ‘আপনারা এখন জামায়াত নিয়ে কেন কথা বলছেন? এখন কথা বলা দরকার ভারতকে নিয়ে। কথা বলা দরকার দুর্নীতি নিয়ে, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়ে।’

নারী নীতিমালাবিরোধী আন্দোলন করতে ২০১০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে যাত্রা শুরু করে হেফাজতে ইসলাম। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় নেমে আলোচনায় উঠে আসে হেফাজতে ইসলাম।

শুরু থেকেই সংগঠনটির আমির ছিলেন শাহ আহমদ শফী। বেশ কয়েক বছর ধরে আহমদ শফির উত্তরসূরী হওয়ার দ্বন্দ্ব চলছিল মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম জুনাইদ ও শফীর ছেলে আনাস মাদানীর মধ্যে। এর জের ধরে গত ১৭ জুন সহকারী পরিচালকের পদ হারান বাবুনগরী। এর কিছুদিন পর মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হলে ১৫ সেপ্টেম্বরে আকস্মিকভাবে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে মাদ্রাসার মধ্যেই। এ সময় মাদ্রাসার প্রধান গেইট লাগিয়ে দিয়ে মাদ্রাসার মধ্যে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। এর প্রেক্ষিতে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার শুরা কমিটি বৈঠকে আনাস মাদানিকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। আর মুহতামিম আহমদ শফী নিজে ‘পদত্যাগ’ করেন। ওই দিনই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শফীকে চটগ্রাম মেডিকেল ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান আহমদ শফী।

শফির পদত্যাগের পর থেকেই হেফাজত ও হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বাবুনগরীর হাতে। এদিকে শফির জানাজায় জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে তুমুল সমালোচনার সৃষ্টি হয়। জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে জুনাইদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে।

তবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে বাবুনগরী হেফাজত ও হাটহাজারী মাদ্রাসায় পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলেছেন আল্লামা শাহ আহমদ শফি পুত্র আনাস সহ তার ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের। এবারের কাউন্সিলে সেটি পাকাপোক্ত করার সব চেষ্টাই করবেন বাবুনগরী— এমন আভাস মিলছে দুই পক্ষ থেকেই।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!