হালিশহরে সুদখোর ‘সুন্দরী’র রাজত্ব, টাকা ধার নিলেই কপালে দুর্ভোগ

এলাকাবাসীর অভিযোগের পরও চুপ পুলিশ

কুলসুমা বেগমকে এলাকার সবাই চেনেন ‘সুন্দরী’ নামে। এলাকার ‘সুন্দরী’ হলেও কাজ তার অসুন্দর। মানুষকে টাকা ধার দিয়ে তিনি আদায় করেন চড়া সুদ। এভাবে তার কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া অনেককে তিনি আবার প্রতারণার মাধ্যমে করেছেন চেকের মামলার আসামি। আবার অনেকের জায়গা-জমিও হাতিয়ে নিয়েছেন। তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর দিয়ে অভিযোগ জমা দিয়েছেন থানায়। কিন্তু এতে তার প্রভাব একটুও কমেনি। প্রশাসনও তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, বরং তাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন— এমন অভিযোগও আছে।

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানার বড়পোল নতুন পাড়ার ঠান্ডামিয়ার গলিতে নিজের রাজত্ব গড়ে তুলেছেন কুলসুমা। হয়েছেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে তিনি ম্যানেজ করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, ঠান্ডা মিয়ার গলিতে সুদ ব্যবসায়ী সুন্দরী নামে পরিচিত কুলসুমা। কুমিল্লা থেকে এসে হালিশহরে বসতি গড়েন তিনি। স্বামী জহির হোসেন মোটর মিস্ত্রি হলেও তিনি মূলত খুঁজে বেড়ান অসহায় মানুষ। যাদের টাকার দরকার, তাদের খুঁজে বের করে তিনি নিয়ে আসেন কুলসুমার কাছে। তারপর চড়া সুদে টাকা ধার দেন। আর জামানাত হিসেবে নেন খালি চেক, সঙ্গে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর।

আর কেউ একবার খালি চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করলেই শুরু হয় কুলসুমার প্রতারণা। কেউ টাকা একেবারে পরিশোধ করে ফেলতে চাইলে তাদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে বাড়তি টাকা আদায়ের ফন্দি আঁটেন তারা। এরপর শুরু হয় চেক ও স্ট্যাম্প দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর কাজ। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এমনকি যে জায়গায় কুলসুমা থাকেন, সেটিও প্রতারণা করে এক ব্যক্তি থেকে হাতিয়ে নেন বলে জানান স্থানীয়রা।

শুধু ঋণগ্রহীতা নন, কেউ যদি ‘সুন্দরী’র কাজে প্রতিবাদ করতে আসেন তাহলে তাকেও পড়তে হয় মিথ্যা মামলার জালে।

সুন্দরী কুলসুমার একই মহল্লার বাসিন্দা সামছুল আলম। পেশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দারোয়ান। বয়স্ক এ লোক প্রতিবাদ করেছিলেন সুন্দরীর কাজ নিয়ে। আর প্রতিবাদ করায় গত ১৬ জুন তার কপালে জোটে হত্যাচেষ্টা ও শ্লীলতাহানির মামলা। জেল খেটে এসে তিনি সুন্দরীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন পুলিশ কমিশনার বরাবরে। অভিযোগে বলা হয়, ঘটনার দিন ভুক্তভোগী সামছুল অফিসে চাকরিরত থাকলেও মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে জেলে পাঠান সুন্দরী।

স্থানীয়রা জানান, একবার যে সুন্দরীর খপ্পরে পড়েছে, তার পুরো পরিবার মামলার আসামি হয়েছে।

৬৫ বছর বয়সী রোকসানা বেগম মেয়ের জামাইয়ের জন্য দুই দফায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা ধার নেন সুন্দরীর কাছ থেকে। বিনিময়ে তিনি দেন ব্যাংকের খালি চেক ও স্ট্যাম্প। কিন্তু সুন্দরীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তার পুরো পরিবারকে মামলার আসামি করা হয়।

রোকসানার ছেলে হামিদুর রশিদ হিমেল বলেন, ‘এ টাকার বিনিময়ে গত দুই বছরে সুন্দরীকে শুধু সুদই দেওয়া হয়েছে ৬ লাখ টাকা। কিন্তু তারপর যখন আমরা চেক ফেরত চাই তখন সুন্দরী দাবি করেন, তিনি আরও টাকা পাবেন। কিন্তু আমরা যে টাকা নিয়েছি তার কয়েকগুণ বেশি টাকা সুদে-আসলে পরিশোধ করেছি। কিন্তু তারপরও তিনি মিথ্যা টাকা দাবি করে ওই চেকের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু তাই নয়, আমি এবং আমার বয়স্ক বাবা নাকি তাকে মারধর করেছি, সেজন্য তিনি আমার ও বাবার নামে মামলা করেছে। মামলার হাত থেকে রেহাই পাননি আমার মাও, তাকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে ওই সুদখোর মহিলা। এমনকি ভয় দেখানোর জন্য এলাকার মাস্তানদেরও নিয়ে আসতেন।’

সুন্দরীর এসব কাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হালিশহর থানা পুলিশ। এমনকি স্থানীয় ৭০ জনের স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্র জমা দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

কুলসুমার সুদ ব্যবসা সম্পর্কে জানেন কি-না— এমন প্রশ্নের জবাবে হালিশহর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মামুন বলেন, ‘যে সুদ খায় ও যে সুদ দেয়, তারা দুজনই অপরাধী।’

একাধিক অভিযোগের পরও সুন্দরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সুন্দরীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে— এমন একটি মামলা দেখান। কোনো তদন্ত কর্মকর্তার নাম বলেন।’ পরে সুন্দরীর বিরুদ্ধে একটি মামলার তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের থানায় আসতে বলেন, আমি কথা বলব।’

আরেক ভুক্তভোগী একই এলাকার গাড়িচালক ওমর ফারুক বলেন, ‘সুদে ধার নেওয়া টাকার কয়েকগুণ বেশি পরিশোধের পরও মামলা করা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। আমি ছাড়াও মামলার শিকার হতে হয়েছে আমার শ্বশুড়, শাশুড়িকেও। আমার শ্বশুড় স্ট্রোক করে এখন শয্যাশায়ী।’

তিনি আরও বলেন, ‘১০ হাজার টাকায় দুই হাজার এবং এক লাখ টাকায় ১০ হাজার টাকা সুদে দুই দফায় টাকা ধার নিই সুন্দরীর কাছ থেকে। আমি সময়মতো সুদ ও আসল পরিশোধের পর সামান্য কিছু টাকা পাওনা ছিল। আমি সামাজিকভাবে সালিশের মাধ্যমে বলেছিলাম, ছয় মাসের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করে দেবো। কিন্তু তারপরও তিনি কোর্টে গিয়ে আমাদের নামে মামলা করেছেন।’

স্থানীয় বাজারের হার্ডওয়্যার দোকানদার আল মামুন বলেন, ‘একবার শ্যালকের জন্য টাকা ধার নিই সুন্দরীর কাছ থেকে। কিন্তু সেই টাকা গত পাঁচ বছরে কয়েকগুণ বেশি শোধ করার পর আরও টাকার দাবি করেন তিনি। আমার শ্যালক ঋণ নেওয়ার সময় আমার ব্যাংক একাউন্টের চেক জমা রেখেছিল। তার কথামতো টাকা না দেওয়ায় স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে মারধর করা হয়। এমনকি দোকানও ভাঙচুর করা হয় আমার। আমি এখন রাতে একা বাসায় যেতে ভয় পাই। তাই বাধ্য হয়ে ওদের বিরুদ্ধে থানায় একটি অভিযোগ করেছি।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সুন্দরী’ খ্যাত কুলসুমা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার কোনো সুদ ব্যবসা নেই।’

তবে সুদে টাকা না লাগালেও ব্যবসায়িক কারণে পার্টনার হিসেবে টাকা ধার দেওয়ার কথা স্বীকার করে সুন্দরী বলেন, ‘আমি ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে রোকসানা, মামুন, শামসুন্নাহারদের টাকা ধার দিই। কিন্তু তারা আমাকে ব্যবসার লাভের ভাগ না দিয়ে উল্টো আমার নামে অভিযোগ দিয়েছে। তাই আমিও তাদের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলা করেছি। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি রায়ের অপেক্ষায় আছে।’

জায়গা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কুলসুমা বলেন, ‘আট-নয় বছর আগে আমি কুন্চু মিয়ার কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনেছি এ জায়গা।’

এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওরা যারা স্বাক্ষর দিয়েছে তারা সবাই বিএনপির লোক, সবাই রিকশাওয়ালা।’ এ সময় প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা চলাকালীন তিনি ‘থানায় আছেন’ বলে জানান।

এদিকে সুন্দরী সুদের ব্যবসার বিষয়টি অস্বীকার করলেও এক মামলার তদন্তে সুদ ব্যবসার সত্যতা খুঁজে পান হালিশহর থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. জসিম উদ্দিন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আদালতে জমা দেওয়া একটি প্রতিবেদনে সুন্দরীর বিরুদ্ধে সুদের ব্যবসা পরিচালনা করার সত্যতা পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়।

বিএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!