হালদা থেকে মাছের প্রজাতি হারাচ্ছে একের পর এক আঘাতে

১৫ প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে কয়েক বছরেই

জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন প্রকল্প এবং দূষণের কারণে হালদা নদী থেকে মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবিকা নির্ভর করা নদীটির জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৯৭৮ সালে এক গবেষণায় মার্কিন মৎস্যবিজ্ঞানী ওয়াল্টার রেইনবোথ এশিয়ার প্রধান কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে ৬৫ প্রজাতির মাছের খোঁজ পান। কিন্তু ২০১৬ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি গবেষণায় মাত্র ৫০ প্রজাতির মাছ খুঁজে পাওয়া যায় নদীটিতে। হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির মধ্যে রয়েছে চিতল, ভেদা, গুইজ্জা আইর, ঘোর পুঁইয়াসহ অনেক প্রজাতির মাছ।

২০১৬ সালের গবেষণায় অংশ নেওয়া গবেষকরা বলছেন, এই ক্ষতির প্রধান কারণ হল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীর লবণাক্ততা বৃদ্ধি। লবণাক্ত জল হালদায় প্রবেশ করে কারণ এটি কর্ণফুলী নদীর একটি শাখা, যা বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। দিনে দু’বার সমুদ্রের উঁচু জোয়ার পানির স্তরকে ৪.৫ মিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, যা হালদার অনেক গভীরে পৌঁছে যায়।

আমতলীতে নদীর ওপর ৪.৫ মিটার উঁচু এই রাবার ড্যামও হালদার জন্য হুমকি।
আমতলীতে নদীর ওপর ৪.৫ মিটার উঁচু এই রাবার ড্যামও হালদার জন্য হুমকি।

বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের লবণ পানি প্রচুর পরিমাণে হালদায় প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে উজানের বাঁধ এবং সেচ প্রকল্পগুলো নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাস করছে, যা পানির লবণাক্ততা কমানোর ক্ষমতা হ্রাস করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রামের নিচে লবণ থাকলে তাকে ‘মিষ্টি পানি’ সংজ্ঞায়িত করে। কিন্তু চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য থেকে জানা যায়, হালদা নদীতে গড় লবণাক্ততার মাত্রা ২০০৭ সালে ২ হাজার ৩৮৫ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। সে বছরই বাংলাদেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে। তারপর থেকে লবণাক্ততা অপেক্ষাকৃত বেশি রয়ে গেছে, কেবলমাত্র পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে মিঠা পানির জন্য ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ডের নিচে নেমে আসে। ২০২১ সালের মে মাসে যখন ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত হানে, তখন লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৯০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে।

লবণাক্ত পানি নদীর কাছে জমিতে প্রবেশ করছে, কিন্তু লবণ অধিকাংশ ফসলের জন্য বিষাক্ত এবং এর ফলে অনেক কৃষক তাদের জীবিকা হারিয়েছে। কেউ কেউ মহিষ পালনের দিকে ঝুঁকেছেন, কারণ এই প্রাণীরা যে ঘাস খায় তা লবণাক্ত পরিবেশের মধ্যে টিকে থাকতে পারে।

শিল্পকারখানার দূষণ হালদা নদীর জীববৈচিত্র্যের চরম ক্ষতি করছে।
শিল্পকারখানার দূষণ হালদা নদীর জীববৈচিত্র্যের চরম ক্ষতি করছে।

আবু তৈয়ব নামের একজন কৃষক জানান, চাষযোগ্য জমিতে আর চাষ করা যায় না। নদীর তীরবর্তী জমিতে বেগুন, করলা, লাল পালং শাক, তরমুজ চাষ করতে সক্ষম ছিলেন। তবে নোনা জলে সেইসব ফসল নষ্ট হয়।

আরেক কৃষক আমিনুল ইসলামের মতে, বাঁধের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি জমিতে প্রবেশ ঠেকানো গেলে সেইসব এলাকায় কৃষি ফিরে আসতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের শৈশবে বছরে তিনবার ধানের চাষ হতো। তরমুজ, হরমুজ, শসা, আলু, মূলা এবং অন্যান্য ফসলও হালদার তীরে জমিতে চাষ করা হতো। কিন্তু এখন সেই বিস্তৃত জমিতে আর চাষাবাদ হয় না।

ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ

সমুদ্র থেকে আসা লবণাক্ত জল হালদার উজান পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের গবেষণায় অংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সভাপতি অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, জোয়ারের জল নিয়মিতভাবে হালদায় প্রবেশ করে। কারণ নদীর মিঠা পানি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এবং কৃষিজমি সেচের জন্য ডাইভার্ট করা হয়েছে। ২০১২ সালে ভূজপুর এলাকার আমতলীতে নদীর ওপর ৪.৫ মিটার উঁচু রাবার ড্যাম স্থাপন করা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে এই বাঁধ হালদায় পানির পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে নদীর ২০ কিলোমিটার নিম্নপ্রবাহ শুকিয়ে যায়। মাছের প্রধান খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন এবং বেন্থোসের উৎপাদন পানিপ্রবাহের অভাবে মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। ফলে মাছের প্রজনন মৌসুমের ঠিক আগে এই খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। হালদার মধ্যে প্রবাহিত হরুয়ালছড়ি খালে আরেকটি রাবার ড্যাম স্থাপন করা হয়েছে। এই বাঁধগুলো চা বাগান এবং ধানের ক্ষেতে জল সরবরাহ করে। এটি করার ফলে তারা হালদার মিঠা পানি থেকে বঞ্চিত হয়। ধুরুং উপনদীর ওপর একটি কংক্রিট বাঁধ সঙ্কটকে আরও গভীর করেছে। হালদাতে প্রবাহিত ১৯টি খালের মধ্যে ১৮টির মুখে অপরিকল্পিত স্লুইস গেট স্থাপন করা হয়েছে, যা মাছের অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং উঁচু এলাকা থেকে পানির প্রবাহ হ্রাস করে।

হারুয়ালছড়ি খালের এই বাঁধ হালদা নদীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হারুয়ালছড়ি খালের এই বাঁধ হালদা নদীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যান্য হুমকি

১৯০৫ এবং ২০০২ সালের মধ্যে কৃত্রিমভাবে চ্যানেল সোজা করার জন্য হালদার বাঁক কেটে ২৫ কিলোমিটারেরও বেশি ছোট করা হয়েছে। এটি বঙ্গোপসাগর থেকে লোনা জলের অনুপ্রবেশকে বাড়িয়ে দিয়ে মিঠা পানি বহন করার জন্য নদীর ক্ষমতা আরও কমিয়ে দিয়েছে।

কিবরিয়া এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বালু উত্তোলন এবং এর মধ্যে রয়েছে হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এশিয়ান পেপার মিলস থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য প্রবাহ, সেইসাথে গৃহস্থালি ও মানব বর্জ্য— যা স্থানীয় লোকজন হালদায় ফেলে।

অন্যান্য হুমকি আসে নদীপাড়ের ইট ভাটা থেকে, যার বর্জ্য নদীতে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তামাক চাষের ফলে নদীতে তামাকের বিষক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আর চিংড়ি ধরার লোভে কিছু অসাধু লোক হালদায় বিষ ঢেলে দেয়। চিংড়ি বিষ থেকে বেঁচে গেলেও, মাছের বিভিন্ন প্রজাতি মারা যায়।

হাটহাজারী উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষ এখন দূষণ কমানোর জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন।

তিনি বলেন, হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এশিয়ান পেপার মিল দুটোকেই বন্ধ রাখা হয়েছে যতক্ষণ না তারা এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু করে। গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলা অনেক কমে গেছে। প্রশাসন তামাক চাষ, ইট ভাটা এবং বালু উত্তোলন বন্ধ করতে সক্রিয়। তামাক চাষ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।

হালদা থেকে অবাধ বালু উত্তোলন চলছেই।
হালদা থেকে অবাধ বালু উত্তোলন চলছেই।

জীববৈচিত্র্য রক্ষা

ড. কিবরিয়া বলেন, হালদায় মানুষের কার্যকলাপ কার্প প্রজাতির মাছের প্রজননকে প্রভাবিত করছে। স্থানীয় মানুষ এই মাছের ডিম সংগ্রহ করে জলাশয়-পুকুরে মজুদ করে, যেখানে তারা প্রাপ্তবয়স্ক মাছ বিক্রি এবং বাড়িতে খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করে। কিবরিয়া বলেন, যেখানে ১৯৪৫ সালে ১ লাখ ৩৬ হাজার কেজি এবং ২০০১ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়েছিল, ২০২১ সালে তা কমে ৮ হাজার কেজিতে নেমেছে। যেখানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে হালদার পোনা ভারত এবং মিয়ানমারে সরাসরি রপ্তানি হতো, এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করাও সম্ভব হয় না।
হালদার কার্প মাছের সুরক্ষার জন্য সরকার ২০০৭ এবং ২০১০ সালে মদুনাঘাট থেকে নদীর উজানে ২০ কিলোমিটার করে মোট ৪০ কিলোমিটারকে ‘মৎস্য অভয়াশ্রম’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এর বাইরে নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য এখনও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সরকার ২০১০ সালে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর স্থানীয় জেলেরা তাদের জীবিকা হারিয়েছে।

বিশু জলদাস নামের একজন মাছ শিকারি জানান, জেলেরা তাদের দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছে। আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।

আরেকজন জেলে রতন জলদাস বর্ণনা করেছেন যে অতীতে তিনি এমন জায়গায় মাছ ধরতে যেতেন যেখানে জাগ ছিল। জাগগুলো বিভিন্ন ধরনের মাছের আশ্রয়স্থল ছিল। ছোট শামুক সেখানে বেড়ে উঠত। কিছু মাছ সেই শামুক খেয়েছে। আবার বড় মাছ ছোট মাছ খেয়েছে। এভাবে একটি বাস্তুতন্ত্র ছিল। এখন হালদা কেবল একটি প্রবাহিত নদী। মাছের বসতির কোনো সুযোগ নেই। প্রজননের কোনো সুযোগ নেই। ফলে কিছু মাছ আর আগের মতো দেখা যায় না।

ড. কিবরিয়া বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য নদীতে মিঠা পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং জোয়ারের সঙ্গে লবণাক্ত পানির প্রবেশ কমাতে হবে। তিনি হালদা এবং বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কর্ণফুলী নদীর জল ধারণক্ষমতা বাড়াতে ড্রেজিং করে চ্যানেলকে গভীর করার সুপারিশ করেন, যা হালদা নদীতে কম লবণাক্ত জল পৌঁছানো নিশ্চিত করবে।

কিবরিয়া উল্লেখ করেছেন যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ২০১৬ সালের গবেষণায় হালদা নদী এবং হারুয়ালছড়ি খালের বাঁধ অপসারণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বাঁধ এলাকায় কম পানির প্রয়োজন এমন সবজি চাষ করার এবং পানির সাথে মাছের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করার জন্য অপরিকল্পিত যে স্লুইস গেটগুলো রয়েছে, এমন উপনদীগুলোকে নাব্যতা ফেরানোর সুপারিশও করা হয়েছিল।’

সুপারিশগুলো এখনও কার্যকর হয়নি। কিন্তু চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোমিনুর রহমানের মতে, পরিবর্তন আসছে।

তিনি বলেন, নদী সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার হালদা ম্যানেজমেন্ট অথরিটি নামে একটি স্বাধীন সংগঠন গঠন করতে চলেছে। কর্তৃপক্ষ গবেষণার সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে এবং নদীর সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!