হালদায় দেড় মাসের মাথায় এবার ‘খুন’ ২৪ নম্বর ডলফিন!

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ‘খুন’ হয়েছে ২৪ তম ডলফিন। ২৩ তম ডলফিনের মৃত্যুর পর মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে আরেকটি ডলফিনকে মৃত অবস্থায় হালদার পাড়ে পাওয়া গেছে।

শুক্রবার (৮ মে) সকালে রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ারচর নামক স্থানে ডলফিনটিকে মাথা বরাবর আড়াআড়িভাবে এবং ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত কেটে হত্যা করা হয়। সেইসাথে ডলফিনের চর্বিও কেটে নেওয়া হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) হালদা নদীর ডলফিনের এই প্রজাতিকে অতি বিপন্ন (লাল তালিকাভুক্ত) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মৃত এ ডলফিনটির দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ওজন ৫২ কেজি। ডলফিনের গায়ে এমন আঘাতের চিহ্ন দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও দ্বিধায় পড়ে গেছে।

ডলফিনের হত্যার খবর পাওয়ার পর পরই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফ-এর কর্মী মিমু দাস এবং স্বেচ্ছাসেবক রওশনগীর দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে মৃত ডলফিনটি উদ্ধার করে গড়দুয়ারা এলাকায় আইডিএফ অফিসে নিয়ে আসেন। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডলফিনটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

এদিকে, এ পর্যন্ত যত ডলফিন মৃত অবস্থায় হালদা নদীতে ভেসে উঠেছিল প্রত্যেকবার ধারণা করা হয়েছিল নদীতে চলাচল করা বালুবাহী নৌযান বা ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রপেলারের (পানির নিচে থাকা ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত পাখা) আঘাতে ডলফিনগুলোর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এবারের মৃত ডলফিন দেখে রীতিমতো কর্তৃপক্ষের চোখ ছানাবড়া। এটিসহ গত আড়াই বছরে ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা, জেলেদের অবৈধ জালে আটকা পরলে ডলফিনটিকে ডাঙ্গায় তুলে হত্যা করে কেটে চর্বি নেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ২১ মার্চ ২৩ তম ডলফিনের মৃতদেহ পাওয়া যায় রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আজিমের ঘাট এলাকায়।

এ প্রসঙ্গে হালদা নদী বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হালদা নিয়ে কাজ করছি পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা পাইনি। এবার এই প্রথম। হত্যাকাণ্ডের এই চিহ্ন বিগত সময়ের মৃত ডলফিনগুলোর চেয়ে একটি নতুন ইঙ্গিত বহন করে। এই ঘটনাটি হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণের জন্য একটি অশনি সংকেত বলে মনে করি। গ্রামে একটা কুসংস্কার আছে ডলফিনের চর্বি নিয়ে। যার জন্য তারা হয়তো এই জঘন্য কাজটা করেছে।’

এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খুবই দুঃখনজক ঘটনা ঘটেছে। এটা কখনও আশা করিনি।হালদায় আমরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ড্রেজার বন্ধ করেছি। সেনাবাহিনীর সাথে কথা বলে তাদের সব কার্যক্রম বন্ধ করিয়েছি। আমাদের যত সমর্থক ছিল সবই করেছি। এখন সমস্যা হচ্ছে করোনার কারণে আটকে গেছি।তারপরও হাটহাজারী হলে কোন বাড়ি, কোন ঘর, কোন এরিয়া, কারা করেছে সব বের করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এমন জায়গায় ঘটেছে, তা একেবারে হাটহাজারী রাউজান সীমান্তের ভেতরে জেলেপল্লীতে। যা বের করা খুব কঠিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনায় আটকে যাওয়ায় এটা একটা সুযোগ নিয়েছে মাছ শিকারীরা। এই মুহূর্তে আমার তিনবেলা হালদায় থাকার কথা। কিন্তু আমি সর্বোচ্চ এক বেলা সময় দিতে পারছি। এই সুযোগটা তারা কাজে লাগিয়েছে। তারপরও আমরা এখন এই বিষয়টার প্রতি আরও নজরদারি বাড়াবো। এখন থেকে সার্বক্ষণিক একটা টিম হালদায় রাখা হবে।’

এদিকে, সারা বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে ডলফিন আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে হালদায় ছিল ১৭০টি ডলফিন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি ডলফিন মারা গেছে। এবারের ডলফিনসহ ২৪টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে হালদায়। তবে এবারের ডলফিনকে হত্যা করা হয়েছে। হালদায় যে ডলফিন দেখা যায় তা স্থানীয়ভাবে উতোম বা শুশুক নামে পরিচিত। মিঠাপানির স্তন্যপায়ী এই প্রাণী গেঞ্জেস বা গাঙ্গেয় ডলফিন। সাধারণত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে এটি বিচরণ করে।

সরকার ২০১০ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। তবে রাউজান উপজেলার ছত্তার খালের মুখ থেকে হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের মূল বিচরণক্ষেত্র। এবারের মৃত এ ডলফিন পাওয়া যায় রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকার ছায়ারচর এলাকায়। আগেরবারের ভেসে উঠা মৃত ডলফিনটি পাওয়া যায় রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আজিমের ঘাট এলাকায়।

এসআর/এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!