হালদায় ‘খুন’ ২৩ ডলফিন, রইল বাকি ১৪৭!

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে তিন মাসের ব্যবধানে আবারও ভেসে উঠল মৃত ডলফিন। শনিবার (২১ মার্চ) হালদা নদীর আজিমের ঘাট এলাকায় ভেসে ওঠে অতি বিপন্ন জলজ প্রাণী ডলফিন। নদীতে চলাচল করা বালুবাহী নৌযান বা ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রপেলারের (পানির নিচে থাকা ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত পাখা) আঘাতে বাকি ২২টি ডলফিনের মতন এই ডলফিনটিও মারা গেল। এটিসহ গত আড়াই বছরে ২৩টি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে হালদা নদীতে বালুবাহী ড্রেজার চলাচল বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

সারা বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে ডলফিন আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে হালদায় ছিল ১৭০টি ডলফিন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি ডলফিন মারা গেছে। হালদায় যে ডলফিন দেখা যায় তা স্থানীয়ভাবে উতোম বা শুশুক নামে পরিচিত। মিঠাপানির স্তন্যপায়ী এই প্রাণী গেঞ্জেস বা গাঙ্গেয় ডলফিন। সাধারণত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে এটি বিচরণ করে।

সরকার ২০১০ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। তবে রাউজান উপজেলার ছত্তার খালের মুখ থেকে হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের মূল বিচরণক্ষেত্র। এবারের ভেসে ওঠা মৃত ডলফিনটি পাওয়া যায় রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আজিমের ঘাট এলাকায়। এর আগের মৃত ডলফিনটি ভেসে ওঠে মদুনাঘাট থেকে এক-দুই কিলোমিটার পশ্চিমে।

হালদায় ‘খুন’ ২৩ ডলফিন, রইল বাকি ১৪৭! 1

জানা যায়, দুই-তিন দিন আগে ডলফিনটিকে মারা যায়। হালদা নদীর তীরে মৃত ডলফিনটি দেখে স্থানীয় বাসিন্দারা ডাঙায় তুলে আনেন। এরপর মৎস্য অধিদপ্তরের লোকজন ও স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা ডলফিনটিকে মাটিচাপা দেন। এটির দৈর্ঘ ৬ ফুট আর ওজন প্রায় ৫০ কেজি।

হালদা নদী বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার মহামারির মধ্যে হালদা নদীতে ২৩তম ডলফিনের অপ্রত্যাশিত (আঘাতজনিত) মৃত্যু।
আগের উদ্ধারকৃত মৃত ডলফিনগুলোর মত এই ডলফিনটির শরীরেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নদীতে চলাচল করা বালুবাহী ড্রেজার ও যান্ত্রিক নৌকার আঘাতে ডলফিনটির মৃত্যু হয়েছে। নদীতে বালুবাহী ড্রেজার ও যান্ত্রিক নৌ চলাচলের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। যার কারণে মা মাছসহ ডলফিন মারা যাচ্ছে অবাধে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডলফিনের দুর্বল দিক হচ্ছে কোনোভাবে যদি একবার আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে আর রিকভার করার সুযোগ থাকে না। তখন আস্তে আস্তে পঁচে গিয়ে মারা যায়। তাছাড়া এই ডলফিনটা বেশি পঁচে যাওয়ায় সংরক্ষণ করার কোনো উপায় ছিল না।’

এক প্রশ্নের জবাবে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ডলফিনকে আঘাত করার কোনো সুযোগ নাই। কারণ এরা সাধারণত জালে আটকায় না। তাছাড়া মানুষ খাবার হিসেবেও গ্রহণ করে না, তাই শিকার করার প্রয়োজন নেই। তবে এটি মারা যাওয়ার একটা কারণ যখন নদীর পানি কম থাকে বা ভাটা হয় তখন বালুবাহী ড্রেজার বা ইঞ্জিন চালিত নৌযানের আঘাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।’

মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘আগের মৃত ২২টি ডলফিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় নৌযানের আঘাতে এগুলোর মৃত্যু কারণ। এবারের ডলফিনটা দুইতিন দিন আগেই মারা যাওয়ায় সংরক্ষণ করার কোনো উপায় ছিল না। তাই মাটিচাপা দেয়া হয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত হালদা নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। যদি অভয়ারণ্যই ঘোষণা করা হবে তবে কেন যান্ত্রিকযানের প্রপেলারের আঘাতে ২৩টি ডলফিনকে মরতে হয়েছে? অভয়ারণ্যে তাহলে ভালই মৃত্যুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে!’

এদিকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বলছে, হালদায় বালুবাহী ড্রেজার চলাচল শতভাগ বন্ধ রয়েছে। তবে স্থানীয়রা জানান হালদা নদীর রাউজান অংশের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের কচুখাইন, মোকামীপাড়া, উরকির চর ইউনিয়নের দেওয়ানজির ঘাট, মদুনাঘাট, আবুরখিল, পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট, গহিরা ইউনিয়নের সত্তারঘাট এলাকায় অবাধে চলছে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন ও যান্ত্রিক নৌযানের চলাচল। সামনে মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম। এই সময়েও নদীতে বালুবাহী ড্রেজার ও যান্ত্রিক নৌকা চলাচল করছে অবাধে।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলফিনটি তিন-চারদিন আগে মারা যাওয়ায় সংরক্ষণ করার অবস্থা ছিল না। তাছাড়া এখন হালদায় সব ধরনের ড্রেজার চলাচল বন্ধ। তাই ঠিক কী কারণে ডলফিনটি মারা গেলো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পঁচে যাওয়ায় ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তবে আঘাতে মারা গেছে তা বোঝা গেছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘নদী ও জলজ প্রাণী রক্ষায় হালদায় সব বালুমহালের ইজারা বাতিল করেছে সরকার। বর্তমানে বালুবাহী ড্রেজার চলাচল শতভাগ বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া সামনে মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম তাই ১৮ মার্চ থেকে সেনাবাহিনীও তাদের কাজ বন্ধ রেখেছে। তবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে যাতে কেউ বালু তোলা বা যান্ত্রিক নৌকা নদীতে প্রবেশ করাতে না পারে, সে জন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। এ পর্যন্ত ৯টি ড্রেজার এবং ১২টি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। একইসাথে তিনজনকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ডলফিনের এই প্রজাতিটিকে অতি বিপন্ন (লাল তালিকাভুক্ত) হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!