হালদায় আবারও ডলফিন হত্যা, রইলো বাকি ১৪৫

মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ‘খুন’ হয়েছে ২৫তম ডলফিন। ৮ ফুট ১ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এবং আনুমানিক ৭০-৮০ কেজি ওজনের এই ডলফিন জেলেদের জালে আটকা পড়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে।

রোববার (২৪ মে) সকাল ১০টায় রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার এলাকায় মৃত ডলফিনটি ভেসে ওঠে। ডলফিনের মুখে জেলেদের কেটে দেওয়া জাল আটকা ছিল।

এ প্রসঙ্গে হালদা নদী বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ সকালে মৃত ডলফিনটি ভেসে ওঠার খবরে আমরা স্পটে গিয়ে ছবি তুলে হালদার ডলফিন সংক্রান্ত কমিটির কাছে পাঠিয়েছি। উনারা বাকিটা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

এর আগে কাছাকাছি স্থানে গত ৮ মে ২৪তম ডলফিনটিকে মাথা বরাবর আড়াআড়িভাবে এবং ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত কেটে হত্যা করা হয়। সেই সাথে ডলফিনটির চর্বিও কেটে নেওয়া হয়। ডলফিনটির দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ২ ইঞ্চি এবং ওজন ৫২ কেজি। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) হালদা নদীর ডলফিনের এই প্রজাতি ডলফিনকে অতি বিপন্ন (লাল তালিকাভুক্ত) হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

৮ মে সর্বশেষ ডলফিনটি হত্যার পর এবারই প্রথম হালদা নদীতে ডলফিন হত্যা বন্ধে কার্যকর নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছিল হাইকোর্টে। করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতে এটি ছিল প্রথম রিট। ওই রিটের ভিত্তিতে ১৯ মে হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য, কার্পজাতীয় মা-মাছ ও ডলফিন রক্ষায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে হাইকোর্ট। এ কমিটির নাম হবে ‘হালদা নদীর ডলফিন হত্যা রোধ, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র এবং সকল প্রকার মা-মাছ রক্ষা কমিটি’। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ১৪ সদস্যের এ কমিটিকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। পরবর্তী শুনানির জন্য ২৮ মে ভার্চুয়াল এ আদালতের কার্যতালিকায় রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, যত ডলফিন মৃত অবস্থায় হালদা নদীতে ভেসে উঠেছিল প্রত্যেকবার ধারণা করা হয়েছিল নদীতে চলাচল করা বালুবাহী নৌযান বা ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রপেলারের (পানির নিচে থাকা ইঞ্জিনের সঙ্গে যুক্ত পাখা) আঘাতে ডলফিনগুলোর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ২৩ ও ২৫তম ডলফিন জালে আটকা এবং ২৪তম হত্যার শিকার ডলফিনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার আলামত ছিল স্পষ্ট।

এদিকে, সারা বিশ্বের বিভিন্ন নদীতে ডলফিন আছে মাত্র ১ হাজার ১০০টি। এর মধ্যে হালদায় ছিল ১৭০টি ডলফিন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২৫টি ডলফিন মারা গেছে। হালদায় যে ডলফিন দেখা যায় তা স্থানীয়ভাবে উতোম বা শুশুক নামে পরিচিত। মিঠাপানির স্তন্যপায়ী এই প্রাণী গেঞ্জেস বা গাঙ্গেয় ডলফিন। সাধারণত দূষণমুক্ত পরিষ্কার পানিতে এটি বিচরণ করে।

সরকার ২০১০ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে জলজ প্রাণির অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। তবে রাউজান উপজেলার ছত্তার খালের মুখ থেকে হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের মূল বিচরণক্ষেত্র। এবার পরপর তিনটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায় রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের জিয়া বাজার ও পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের আজিমের ঘাট এলাকায়।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হালদা নদীতে পরিচালিত ইউএনডিপির সহযোগিতায় গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বনবিভাগের পরিচালিত এক জরিপে হালদায় মাত্র ৪৫টি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তখন।

জরিপে বলা হয়েছে, জরুরি উদ্যোগ নিলে এ বিদ্যমান সংখ্যা থেকে ডলফিনকে দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ করা যাবে। সংরক্ষণ তো দূরের কথা, সেই ৪৫টি থেকে মৃত্যু হয়েছে ২৫টি ডলফিনের।

এফএম/এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!