হামজা ব্রিগেডের ৬১ জনের বিচার শুরু, বিএনপি নেত্রী শাকিলাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গহীন অরণ্য থেকে আটক হওয়া জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের’ ৬১ সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার কাজ শুরু করা হয়েছে। দুইবার পিছিয়ে এ অভিযোগ গঠনের সময় মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বিদেশে থাকায় তাকেসহ অনুপস্থিত থাকা নয়জনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

৮ সেপ্টেম্বর মামলাটির পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আবদুল হালীম শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। এর আগে ১১ জুন জামিনে গিয়ে লন্ডনে থাকা শাকিলার আইনজীবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তারিখ পিছিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭ জুন। পরে ৩০ জুলাই পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত হলেও ওই দিন আবার বিচারক শূন্যতায় তা গঠন হয়নি।

শাকিলা বিএনপির সাবেক হুইপ প্রয়াত সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক। জামিনে গিয়ে হাজির না হওয়ায় মঙ্গলবার বিচারক তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দিয়েছেন।

তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, ‘চিকিৎসকার জন্য শাকিলা ফারজানা লন্ডনে থাকায় আমরা সময়ের আবেদন করেছিলাম কিন্তু আদালত সময়ের আবেদন নাকচ করে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।’

আদালত সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের করা বাঁশখালীর মামলায় ৩৩ এবং হাটহাজারীর মামলায় ২৮ জনের বিরুদ্ধে হামজা ব্রিগেডের সদস্যদের পৃথকভাবে অভিযোগ গঠন করেন। আসামিদের মধ্যে ঘটনার শুরু থেকে পলাতক ৭। অভিযোগ গঠনের সময় ব্যারিস্টার শাকিলা ও নাছির ছাড়া বাকি আসিমরা হাজির ছিলেন।

এই দুই মামলার আসামিরা হলেন হামজা ব্রিগেডের সামরিক প্রধান মনিরুজ্জামান ডন, আজিজুল হক, আশফাকুর রহমান, আমিরুল ইসলাম হামজা, হাবিবুর রহমান,শফিকুল ইসলাম শেখ, আবদুল খালেক হোরাইরা, মোবাশ্বের সামাদ খান ও আমির হোসেন ইসহাক, ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা।

দুটি মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, বাহরাইনের নাগরিক আল্লামা লিবদির নির্দেশে দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে আসামিরা নতুন জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলেন। দেশে তাদের বড় ভাই ওরফে জুনাইয়েদ নামের একজন তাদের পরিচালনা করতেন। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা বড় ভাই সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি। হামজা ব্রিগেডকে সামরিক, দাওয়াহ ও মিডিয়া নামের তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। সামরিক বিভাগকে হোয়াইট, ব্লু ও গ্রিন নামে ভাগ করেন।

সামরিক বিভাগের প্রধান হলেন মনিরুজ্জামান ওরফে ডন, দাওয়াহ বিভাগের প্রধান নাছির হোসেন, মিডিয়া বিভাগের প্রধান মো. আবদুল্লাহ। জঙ্গিদের কাছে অস্ত্রগুলো বিক্রি করেন অস্ত্র ব্যবসায়ী মোজাহের মিয়া। জঙ্গি অর্থায়নের জন্য মনিরুজ্জামান ওরফে ডনের তিনটি হিসাব নম্বরে আইনজীবী শাকিলা ফারজানা দুই দফায় ২৫ লাখ ও ২৭ লাখ টাকা, হাছানুজ্জামান দুই দফায় ১৫ লাখ ও ১৬ লাখ টাকা, মাহফুজ চৌধুরী ২৫ লাখ জমা করেন।

হাটহাজারী ও বাঁশখালী থানার দুই মামলায় ৬১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন করেন সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি মনোরঞ্জন দাশ।

শুনানিতে আদালতকে তিনি বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য আসামিরা কেউ জঙ্গিদের অর্থায়ন করেছেন। আর কেউ প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের মজুত করেছেন। র‌্যাবের তদন্তেও বিষয়টি উঠে এসেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।

আসামিদের মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন ১০ আইনজীবী। শুনানিতে তারা বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা কেউ জঙ্গি নন। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতাদর্শী হওয়ায় ষড়যন্ত্র করে তাঁদের এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে। শাকিলাসহ তিন আইনজীবী নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপির নেতা–কর্মীদের আইনি সহায়তা দিয়েছেন। এ কারণে তাঁদের মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। মামলা পরিচালনার জন্য মক্কেলের কাছ থেকে যেকোনো আইনজীবী অর্থ নিতে পারেন। কিন্তু সেটি কোনো জঙ্গির দেওয়া অর্থ নয়।

উল্লেখ্য, তদন্তে জঙ্গি সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড’কে এক কোটি ৮ লাখ টাকা দেয়ার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডি থেকে বিএনপি নেত্রী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা দুই সহযোগী আইনজীবীসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ৬ জুন ২০১৬ শাকিলা জামিনে মুক্তি পান। চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশ ছেড়ে শাকিলা ফারজানা পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। মামলায় ১০২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর মাদরাসাতুল আবু বকরে অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে আটক করেছিল র‌্যাব। জব্দ করা হয়েছিল কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ জঙ্গিপন্থী ধর্মীয় বই। ওই মাদরাসা তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মাদরাসায় তাদের মোটিভেশনাল শিক্ষা চালানো হতো। জঙ্গীদের দেওয়া তথ্যে দুই দিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমণি পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র-গুলিসহ পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই পাহাড়ে চলতো তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ। ২৮ ফেব্রুয়ারি হালিশহর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৭৬ হাত বোমা, বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জামসহ আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই সংগঠনের ২৮জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছিল র‌্যাব।

বাঁশখালীর গহীন পাহাড় থেকে হামজা ব্রিগেডের পাঁচটি একে ২২, একে ২২-এর ১০টি ম্যাগাজিন, একটি বিদেশি পিস্তল, একটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, একটি একনলা বন্দুক, একটি এলজি, ২ হাজার ১৫৫ রাউন্ড পয়েন্ট টুটু বোরের গুলি, ৫০১ রাউন্ড শটগানের গুলি উদ্ধার করেছিল র‌্যাব। এসব ঘটনায় ৪ মামলা দায়ের করা হয় হাটহাজারী, বাঁশখালী, কোতোয়ালী ও হালিশহর থানায়।

এডি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!