হাত ধুতে আবার দেড় কোটির ধান্ধা চট্টগ্রামে, ২৪ কোটি টাকার হরিলুট করোনাকালেই

প্রথম প্রকল্পে বসানো বেসিন এখন ময়লার ভাগাড়

করোনার সময় সাধারণ মানুষকে হাত ধোয়ায় অভ্যস্ত করতে ২৪ কোটি টাকা খরচ করে চট্টগ্রামে বসানো হয় ১২০০ বেসিন। তবে সেসব বেসিন অল্পদিনেই ভাগাড়ে পরিণত হয়। আবার অনেক বেসিন ও পানি সরবরাহ করার যন্ত্রপাতিও চুরি হয়ে যায়। প্রথম প্রকল্পের টাকা জলে যাওয়ার পর আবারও চট্টগ্রামে বেসিন বসানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়বারের এই হাত ধোয়ার স্টেশন স্থাপনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। এই প্রকল্পে শুধুমাত্র সাত উপজেলায় ৬৩টি হাত ধোয়ার স্টেশন নির্মাণ করা হবে। তবে হাত ধোয়ার স্টেশন নির্মাণ করা হলেও প্রকল্পে নেই সাবান বরাদ্দ। সাবানের জন্য আবার দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, মীরসরাই, পটিয়া, সন্দ্বীপ, চন্দনাইশ, সীতাকুণ্ড এবং বাঁশখালী উপজেলায় ৯টি করে মোট ৬৩টি হাত ধোয়ার স্টেশন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পে হাত ধোয়ার বেসিনে পানি সরবরাহের জন্য থাকবে সাবমারসিবল পানির পাম্প। পানি সংরক্ষণ করা হবে গাজী ট্যাংকে। হাত ধোয়ার বেসিন স্থাপনের জন্য সাড়ে তিন ফুট একটি লম্বা একটি স্টেশন তৈরি করা হবে। আর এই প্রকল্পটির দায়িত্ব পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লাকী এন্টারপ্রাইজ’। প্রতিষ্ঠানটি জুনে দরপত্র পেলেও এখনও কাজ শুরু করেনি। তবে এই হাত ধোয়া প্রকল্প সরকারি টাকার হরিলুট ছাড়া কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ।

এর আগে চট্টগ্রামের ১৫ জেলার বসানো প্রতিটি ৮০টি করে মোট ১২০০ বেসিনের প্রতিটি ২ লাখ টাকা করে খরচ ধরা হয়। যার মোট খরচ দাঁড়ায় ২৪ কোটি টাকা।

নগরী ও উপজেলায় যেসব জায়গায় বেসিন বসানো হয় সেখানে গিয়ে বেসিনের অস্তিত্ব মেলেনি। আবার অনেক জায়গা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় পানির কল ছিল না। চট্টগ্রাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগে স্থাপন করা বেসিনে ১০-১৫ দিন হাত ধোয়া চললেও এরপর সেটি ভাগাড়ে পরিণত হয়। পরে সেখানে ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ার (ওসেক) স্থাপন করা হলেও হাত ধোয়ার বেসিন আর বসানো হয়নি।

জানা গেছে, ভালো মানের একটি হাত ধোয়ার বেসিনের মূল্য ৬ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। পানির পাম্পসহ যার খরচ সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনিতে সাড়ে তিন ফুট লম্বা একটি স্টেশন তৈরিতে ২ লাখ ২৯ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে গাজী ট্যাংক, ইটের গাঁথুনিসহ বেসিনের মূল্য আর সাবমারসিবল পানির প্যাম্পের জন্য এই খরচ ধরা হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্পের আওতায় প্রবাহমান পানি সরবরাহসহ হাত ধোয়ার স্টেশন নির্মাণের এই উদ্যোগ নিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

প্রকল্প সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হলেও হাত ধোয়ার জন্য সাবানের ব্যবস্থা করা হয়নি। সেসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হবে, যারা এটির দেখভাল করতে পারবে এবং সাবান সরবরাহ করতে পারবে। একই সক্ষমতা যেসব হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকের রয়েছে সেখানেও এই স্টেশন নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্পের নথিতে উল্লেখ করা হয়, যে সকল স্থানে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই সেখানে সোলার এনার্জি সাপোর্টেড সাবমারসিবল পাম্পযুক্ত পানি সরবরাহসহ যাবতীয় ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকলে হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশনের সঙ্গে দুটি সোকপিট যুক্ত করা হবে। প্রবাহমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকলে সাবমারসিবল পাম্পসহ নলকূপ স্থাপন করতে হবে। কোনো উচ্চ জলাধার স্থাপন করার উপযুক্ত কাঠামো না পাওয়া গেলে জলাধার স্থাপন করার জন্য একটি সুপার-স্ট্রাকচার তৈরি করতে হবে।

এছাড়া পানির গুণগতমান নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে পানির পয়েন্টসহ ছোট আকারের পানি পরিশোধনের ইউনিট স্থাপন করার কথাও উল্লেখ আছে প্রকল্পের নথিতে।

চট্টগ্রাম জনাস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এবং নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস কম, তাই করোনার বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে জেলা, উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে বস্তিবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা কম। কোভিড-১৯-এ হাত ধোয়া মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে গতবার পানির উৎস না থাকায় কেউ বেসিনে হাত ধুয়নি। বরং এটি আরও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। তাই পানির উৎস স্থাপনে প্রকল্পে জোর দেওয়া হয়েছে।’

গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. তবিবুর রহমান বলেন, ‘আসলে যুগের সঙ্গে সবকিছুই পাল্টায়। আগে ক্যামেরা ছিল, টিভি ছিল, এখন সেই জায়গা দখল করেছে মোবাইলফোন। সেরকমই আগে মানুষ বালতিতে পানি নিয়ে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করত, এখন সেই ব্যক্তিই বেসিনে দাঁড়িয়ে হাত পরিষ্কার করতে চায়। আমরা হাত ধোয়ায় নতুনত্ব আনতে চেয়েছি।’

আগের প্রকল্পে হাত ধোয়ায় ব্যবহৃত বেসিন ভাগাড়ে পরিণত হওয়ার পর আবার কেন নতুন প্রকল্প—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প যখন পাস হয় তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমি পরে এই প্রকল্পের দায়িত্ব পাই। আশা করছি, আমরা নতুন কিছু দেখাতে পারব।’

হাত ধোয়ার স্টেশন নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তাতে সাবান সরবরাহ না করার কারণে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে স্টেশন নির্মাণ হোক। তারপর আমরা সাবানের জন্য টেন্ডার করব।’

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাবমারিসিবল পানির পাম্প যখন স্থাপন করা হবে, তখন তার পাহারাদার নিযুক্ত করতে হবে। প্রতিটি স্কুল, হাসপাতালে টিউবওয়েল আছে। যেখানে দাঁড়িয়ে বালতিতে করে পানি নিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া যায়। কিন্তু সেটি না করে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাত ধোয়ার নামে সরকারি অর্থ লুটপাট ছাড়া আর কিছু না। সহজ ভাষায় বলা যায়, এসব প্রকল্প দুর্নীতির অভয়ারণ্য।’

প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার লাকী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বেসিন, পানির পাম্পসহ যাবতীয় সবকিছু বাজার মূল্যে কিনেছি, কোনো নয়-ছয় হয়নি। আমরা বাজেটের মাধ্যমেই কাজটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করব।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!