হাটভরা গরু চট্টগ্রামের বিবিরহাটে, শুক্রবারের অপেক্ষায় বিক্রেতারা

৬-৭ লাখও হাঁকা হচ্ছে কোনো কোনো গরুর দাম

চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুর বিবিরহাটে বড় সাইজের ১৩টি গরু এনেছেন ব্যাপারি নওশের মিয়া। ঝিনাইদহ জেলার বাগাডাঙ্গা এলাকা থেকে আনা ১৩টি বড় গরুর একটিও বিক্রি করতে পারেননি তিনি। কিন্তু দাম হাঁকছেন আকাশছোঁয়া। বড় সাইজের প্রতিটি গরুর দাম তিনি চাইছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা।

হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে।
হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে।

দাম বাড়তি হাঁকার বিষয়ে জানতে চাইলে এই ব্যাপারি বলেন, গরু লালন-পালনের খরচ বেড়েছে। দাম বেড়েছে গো খাদ্যের। আর হাটে আনতে গাড়ি ভাড়া গেছে গতবারের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি। প্রতিদিন গরুর পিছনে খরচ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা। তাই এ খরচও একইসাথে লাভ পুষিয়ে নিতে চান তারা। তবে এও বলেন, এ দামই রাখবেন নাকি আর একটু কম করবেন তা বোঝা যাবে শুক্রবারে। কারণ ওইদিন গরুর হাট জমে উঠবে।

শুধু নওশের মিয়া নয়, বিবিরহাটের প্রায় অর্ধশত ব্যাপারির সাথে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাদের অভিমত তারা গরুর দামে বাড়তি ছকেই কষছেন। গতবছর তাদের লোকসান দিয়ে গরু বিক্রি করে চলে যেতে হয়েছে। তাই এবার তারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান।

বুধবার কয়েক ঘন্টা হাঁটে অবস্থান করে দেখা গেলো গরুর সরবরাহ ভালো। ব্যাপারিরা ক্রেতার কাছে গরু বিক্রি করতে সব পরিকল্পনা গোছাচ্ছেন। তবে হাঁটে ক্রেতার দেখা মিলেছে কম। যে দুই-একজন আসছেন, তারা দামদর করে বেশি দাম দেখে চলে যাচ্ছেন।

বিবিরিহাটের স্থানীয় পারভেজ প্রতিবছরের মত এবছরও ২২টি গরু নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। এর সবই মাঝারি ও বড় সাইজের গরু। ৭৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে তার কাছে। পারভেজ জানান, ২২টি গরুর মধ্যে তার ১০টি গরু বিক্রি হয়ে গেছে। আশা করি শুক্রবার থেকে হাট জমে উঠলে তার সবগুলো গরুই বিক্রি হবে।

কথা হলো ব্যাপারি বেল্লাল হোসেন বাবরের সাথে। ১৭টি গরুর বিক্রির জন্য এসেছেন কুমিল্লা ব্রাক্ষণপাড়া থেকে। ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় একটি বিক্রি করেছেন। তার কাছে নেপালি, শাহীওয়ালা, অস্ট্রেলিয়ান জাতের গরু রয়েছে। গরুগুলোর দাম হাঁকছেন ৮৫ হাজার থেকে শুরু করে ৬-৭ লাখ টাকা।

ইমন সওদাগর হাটে এনেছেন ২৭টি গরু। এর মধ্যে ১০টি বিক্রি হয়ে গেছে। শাহীওয়াল, ফিজিয়ান ও দেশি জাতের গরু তিনি বিক্রি করছেন। তার গরুগুলোর দাম ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখের মধ্যে।

ইমন ব্যাপারি বলেন, আমি এ দামেই গরু বিক্রি করব। তবে শুক্রবারে হাট জমলে বোঝা যাবে দাম এটাই থাকবে, নাকি আরো বাড়বে?

তবে তিনি লোডশেডিংয়ের কারণে গরুর যত্ন নিতে পারছেন না বলে জানান। তার গরুর জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় ইমন স্ট্যান্ড ফ্যানের ব্যবস্থা করতে পারেননি।

এদিকে হাঁট ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ না থাকায় পাম্প থেকে পানি তোলা বিঘ্নিত হচ্ছে।। গরুকে গোসল করানো ছাড়াও খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ব্যাপারিদেরও। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটি, সেটির কথা বলতে গিয়ে এ ব্যাপারি বলেন, হাটে খাবার পানির সংকট। আমরা বোতলের পানি কিনে খাচ্ছি। গরুকেও খাওয়াচ্ছি।

গরমে বড় সাইজের গরুগুলোকে হাসফাঁস করতে দেখা গেছে। অনেকের মুখে ফেনার মত জমেছে। মাটিতে অচেতনের মত শুয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেক গরুকে।

রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ২২টি গরু নিয়ে হাটে এসেছেন সিরাজুল ইসলাম। তার কাছে বলদ, বিরিষ ও দেশি জাতের গরু রয়েছে। ২২টির মধ্যে তিনটি গরু বিক্রি হয়ে গেছে। ৭০-৭৫ হাজার থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে জানান সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ দামেই তিনি গরু বিক্রি করবেন।

তার সাথে থাকা আরেক ব্যাপারি সামিরুলও এসেছেন রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। তিনি এনেছেন ২১টি গরু। চারটি বিক্রি হয়েছে। তিনি গরুর দাম হাঁকছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত।

মনিরুল ইসলাম মাত্র ১২টি গরু নিয়ে এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই। তিনিও গরুগুলোর প্রতিটির দাম হাঁকছেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

ওই এলাকার আরেক ব্যাপারি রহিম ১২ থেকে ১৪ বছর ধরে গরুর ব্যবসা করে আসছেন। তিনি এনেছেন মাঝারি সাইজের ১০টি গরু। দাম হাঁকছেন ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

যশোর থেকে মিন্টু ব্যাপারি এনেছেন ১৯টি গরু। তার গরুর দাম ১ লাখ ৩৫ থেকে শুরু। সর্বোচ্চ দামের গরু রয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকার। প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পাওয়া নিয়ে কতটুকু আশাবাদী— এমন প্রশ্নের জবাবে মিন্টু ব্যাপারি বলেন, শতভাগ আশাবাদী। কারণ শুক্রবার ও শনিবার ক্রেতার ভিড় বাড়লে গরুর সংকট দেখা দেবে।
হাঁট ঘুরে ব্যাপারি হুমায়ুনের কাছে ছোট সাইজের গরু দেখা গেলো— যেগুলোর দাম ৫০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা।

নওগাঁ থেকে ৭ জন ব্যাপারির এক দল নিয়ে হাঁটে এসেছেন ব্যাপারি আব্দুল মতিন। তিনি হাটে বিক্রির জন্য এনেছেন ২০টি গরু। বড় সাইজের গরু তার কাছে রয়েছে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজারের মধ্যে। মাঝারি গরু ৯০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে। আর ছোটগুলো ৯০ হাজারের নিচে।

আব্দুর মতিন বলেন, তার গরুগুলোর সবই দেশি জাতের। বাড়ির খামারে গরুগুলো লালন পালন করে বড় করেছেন। গরুর দাম বেশি হাঁকা প্রসঙ্গে এই ব্যাপারি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়তি। ক্রেতার দেখা নেই। তাই আগামী দুইদিনই তাদের বেচাবিক্রির টার্গেট।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আবুল বাশার এনেছেন বড় সাইজের ৬টি গরু— যেগুলোর দাম ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, গরুগুলো গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ার জোগাড় হয়েছে। গরমের জন্য স্ট্যান্ড ফ্যান সেট করতে পারিনি। গরুগুলো বাতাসের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।

বিবিরহাটের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে দেখা গেলো গরুর নারী ব্যাপারি সালমাকে। তিনি এসেছেন রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। এনেছেন ১০টি গরু। রাজশাহী কলেজ থেকে মাস্টার্স করে তিনি বাড়িতে নিজের গরুর খামার গড়ে তোলেন। তার ১০টি গরুর একটিও বিক্রি হয়নি। তবে তিনি আশা করছেন, তার প্রত্যাশিত দামেই তিনি গরুগুলো বিক্রি করতে পারবেন।

বিরিহাট গরুর বাজার পরিচালনা কমিটির পরিচালক মো. ফয়সাল বলেন, আমরা স্বাস্থ্যবিধি পালন করে হাট পরিচালনা করে আসছি। হাটে ক্রেতা ও বিক্রেতার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ব্যাপারিদের যেকোন সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হাটে খাবার পানির সংকট দূর করা হবে।

ফয়সাল জানান, ৬ জন মিলে এ হাটটির ইজারা নিয়েছেন তারা।

বিবিরহাট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে। ১০ থেকে ১২ জন মিলে বড় ডেকচিতে ভাত-তরকারি রান্না করে গোল হয়ে বসে ভোজনপর্ব সারছেন। গরুর ডোগার ওপর মাচা বেঁধে সেখানেই ব্যাপারিরা ঘুম ও বিশ্রাম নিচ্ছেন।

জানা গেছে, এবারের হাটেও প্রতি ব্যাপারিকে ‘ডোগা খরচে’ ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। ফরিদপুর, মাগুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া থেকে ব্যাপারিরা বেশি এসেছেন বিবিরহাটের পশুর হাটে।

তবে এবারের হাটে যুবরাজ, রাজা, বাদশা, ডন, বিগবস— এরকম কোনো বাহারী নামের গরুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যান্য বছর বিক্রেতারা শখ করে গরুদের বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকতেন।

এবার এটি কেন করা হয়নি— এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যাপারি সেকান্দার বলেন, ‘আরে ভাই গরু আদৌ বিক্রি হবে কিনা এটি নিয়ে টেনশনে আছি। ক্রেতা নেই। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। তাই এসব চিন্তা এবার আমাদের মাথায় আসেনি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!