হলি ক্রিসেন্টকে ‘ঢাল’ ধরে চট্টগ্রামে ক্লিনিক সিণ্ডিকেটের অভিনব চালাকি

ক্লিনিক ব্যবসা সচল রাখতে একাট্টা সবাই

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউ সুবিধা অধরাই থেকে গেল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশনাই মানছে না ক্লিনিকের মালিকরা। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করার ১৫ দিনেও করোনা রোগীদের আইসিইউ সুবিধা দিচ্ছে না ক্লিনিকগুলো। বরং নিজেদের ক্লিনিক ব্যবসাকে সচল রাখতে রাখতে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকরা সিন্ডিকেট করেই বন্ধ থাকা হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজন হলে সব হাসপাতালের আইসিইউ সুবিধা পেতো আক্রান্ত রোগীরা। এখন ক্লিনিক সিন্ডিকেটের কূটকৌশলে সেই সুবিধা অধরা থেকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আইসিইউ সুবিধা না পেয়ে করোনা রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে বিভাগীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত হয়েছিল চার সদস্যের কমিটি হাসপাতালগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিটির চার সদস্য সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১২টি হাসপাতালের তালিকা চূড়ান্ত করেন।

৪ ধাপে পর্যায়ক্রমে এই হাসপাতালগুলোর শতাধিক আইসিইউ বেড ব্যবহারের কথা জানিয়ে গত ৪ এপ্রিল একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রতি ধাপে তিনটি করে হাসপাতাল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তাতে। এই তিনটি হাসপাতালের সিট পূর্ণ হলে পরের তিনটি ব্যবহার করার কথা ছিল।

চার সদস্যের সুপারিশ অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের আইসিইউ বেড ব্যবহার করার যে তালিকা করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রথম ধাপে ছিল পাঁচলাইশের পার্ক ভিউ হাসপাতাল, জিইসি মোড়ের মেট্রোপলিটন হাসপাতাল এবং খুলশীর ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল।

এই তিনটির আইসিইউ বেড পূর্ণ হলে দ্বিতীয় ধাপে নাম ছিল কাতালগঞ্জের সার্জিস্কোপ হাসপাতাল (ইউনিট -২), পাঁচলাইশের ডেল্টা হাসপাতাল এবং পাঁচলাইশের সিএসটিসি হাসপাতালের। এর পরের ধাপে ওআর নিজাম রোডের সিএসসিআর হাসপাতাল, মেহেদিবাগের ন্যাশনাল হাসপাতাল এবং ওআর নিজাম রোডের এশিয়ান স্পেশালাইজড হাসপাতাল। আর সর্বশেষ ধাপে ছিল ওআর নিজাম রোডের রয়েল হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন হাসপাতাল এবং মেহেদিবাগের ম্যাক্স হাসপাতাল।

এই করোনা দুর্যোগেও অনেকে উদারভাবে এগিয়ে আসলেও নিজেদের মানবিক পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলেন ক্লিনিক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তাদের এই কূটকৌশলে তারা ব্যবহার করলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে— এমন অভিযোগও করেছেন স্বাস্থ্যখাতের কয়েকজন নেতা। বাস্তবেও হয়েছে সেটিই। মেয়রকে দিয়ে বন্ধ থাকা হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের মালিক পক্ষকে রাজি করিয়ে সেটাকে ১০০ শয্যার ‘করোনা ক্লিনিক’ হিসেবে ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হয়।

কথিত এই ‘করোনা ক্লিনিকে’ ১০০ শয্যার মধ্যে ২০টি আইসিইউ ও ৮০টি জেনারেল বেডের পরিকল্পনার কথা জানা গেছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি টাকা। ১২ কোটি টাকার বিশাল অংক দেখিয়ে সহানুভূতি কুড়ানো হলেও সেখানে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি! ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্য ধরা হয়েছে ২০টি আইসিইউ বেড ও ৮০টি জেনারেল বেডের মূল্য। যা করোনা দুর্যোগ কেটে গেলে যার বেড সে নিয়ে যাবে। বাকি দুই কোটি টাকা বন্ধ থাকা হলি ক্রিসেন্টের গ্যাস, ওয়াসা, বিদ্যুৎ লাইনসহ অন্যান্য খাতে খরচ ধরা হয়েছে। এদিকে আবার এই দুই কোটি টাকার যোগান দিতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিকে চাপ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

তবে তা অস্বীকার করেছেন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতি চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খান। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সমিতিতে ৫০ জন সদস্য আছি। আমরা নিজেদের ফান্ডেই হলি ক্রিসেন্টকে করোনার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে রূপ দিচ্ছি। কারণ প্রতিটি ক্লিনিকেই সব রোগের রোগী ভর্তি আছেন। করোনা রোগী ক্লিনিকে ভর্তি হলে তা অন্য চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থেকেই যায়। এতে একজন চিকিৎসক থেকে তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অন্য রোগের রোগীরাও আক্রান্ত হবে। তাই সবাই মিলে নিজেদের হাসপাতাল থেকে আইসিইউ বেড ও জেনারেল বেড দিয়ে আমরা ১০০ শয্যা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসনকে হস্তান্তর করবো। চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল আমরা দেবো। পরিচালনা করবে জেলা প্রশাসন। আর কোন ওষুধ কোম্পানি থেকে আমরা নগদ অর্থ চাইনি। আমাদের উদ্যোগে তারা পাশে থাকতে নিজেদের থেকে এগিয়ে আসায় আমরা বলে দিয়েছি, হাসপাতাল চালু হলে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে রোগীদের পাশে থাকতে। তারাও রাজি হয়েছেন কিছু ওষুধ ফ্রি সরবরাহ করতে।’

কবে নাগাদ জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে জানতে চাইলে ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ‘আগামী ২৫ তারিখের মধ্য আশা করি তৈরি হয়ে যাবে। পরিপূর্ণ ১০০ শয্যার হাসপাতাল আমরা জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দিতে পারবো।’

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি দুটি হাসপাতালে কার্যক্রম চলছে। একটি আন্দরকিল্লাস্থ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, অপরটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় জেনারেল হাসপাতালের ১০০টি, বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৫০টি আইসোলেশন বেড এরই মধ্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। দুটির একটিতেও এখনও আইসিইউ সুবিধা নেই। তবে জেনারেল হাসপাতালে ভেন্টিলেটরসহ ১০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের কাজ চলছে। মঙ্গলবার কিংবা বুধবার থেকে তা চালু হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!