হলিক্রিসেন্ট করোনা হাসপাতালে চার দিনে জোটেনি একবেলা ভাত, চেয়ে মেলেনি পানি

ওয়াশরুম ভরে আছে ময়লাযুক্ত পানিতে। গড়িয়ে কেবিনে ঢোকার উপক্রম। চিকিৎসা তো দূরের কথা— করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়ার চার দিনেও নমুনা নিতে আসেনি কেউ। পানি খাওয়ার জন্য একটি গ্লাস মিলেনি চেয়েও। চার দিন ভর্তি থেকে জোটেনি একবেলা ভাত। পানি আর বিস্কুট খেয়েই এখানে তাকে গুণতে হয়েছে দিন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন নির্দয় আচরণ দেখে সুস্থ হওয়ার চিন্তার বদলে তার মনে ঢুকে গেল অনাহারে মারা যাওয়ার ভয়।

সরকারের একজন সাবেক যুগ্ম সচিবের সঙ্গেই এমন আচরণ করেছে চট্টগ্রাম নগরীর হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল।

ভুক্তভোগী মঈনুল ইসলাম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ছিলেন। চট্টগ্রাম, বান্দরবানসহ বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বর্তমানে থাকেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায়। করোনা উপসর্গ নিয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর জাকির হোসেন রোডের হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে।

অনন্যোপায় হয়ে হাসপাতাল থেকেই এই দুর্দশার কথা তিনি জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ড. গাজী সালেহ উদ্দিনকে। এসব শুনে হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কোন সমাধান পাননি ড. গাজী সালেহ উদ্দিন।

হলিক্রিসেন্ট করোনা হাসপাতালে চার দিনে জোটেনি একবেলা ভাত, চেয়ে মেলেনি পানি 1

প্রতিবেশী মাইনুলকে বাঁচাতে তিনি যোগাযোগ করেন তার ছাত্র তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তৌহিদ। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক তৌহিদের উদ্যোগেই হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তাকে স্থানান্তর করা হয়েছে হালিশহরের স্থাপিত করোনা আইসোলেশন সেন্টারে।

এ বিষয়ে ড. গাজী সালেহ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মঈনুল সাহেব আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু। অনেক সৎ একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। যুগ্ম সচিব হয়ে তিনি অবসরে যান। বাড়ি নোয়াখালীর সোনাগাজীতে। এখন থাকেন নগরীর পাহাড়তলী থানা এলাকায়। তিনি আমার প্রতিবেশীও। দীর্ঘদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত তিনি। তার পরিবারের অন্যান্যদেরও জ্বর। তারা বাসায় আইসোলেশনে রয়েছে। মঈনুলের হার্টে সার্জারি হয়েছিল। জ্বর বেশি হওয়ার তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তাই আমি তাকে প্রথমে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হতে বলি। তিনি সেখানে যান। করোনা উপসর্গ থাকার কথা বলে ইম্পেরিয়াল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি করায়নি। মঈনুল এরপর জেনারেল হাসপাতালে চলে যান। সেখানেও তার চিকিৎসা হল না। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে। এই হাসপাতালে তাকে না দেওয়া হল চিকিৎসা, না নেওয়া হল তার নমুনা। এমনকি চার দিনে একবেলা খাবারও দিল না তাকে।’

গাজী সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, ‘এসব তিনি আমাকে জানানোর পর আমি আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র তৌহিদুল ইসলামকে বলি মঈনুলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। মঈনুল তাকে দেখতে গেল হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে৷ সঙ্গে খাবারদাবার নিয়ে গেল। দেখে এসে সে যেটা বর্ণনা করলো সেটা রীতিমতো ভয়ংকর। বুঝলাম, মঈনুলকে বাঁচাতে হলে তাকে আগে হলিক্রিসেন্ট থেকে বের করে আনতে হবে। এখন আমি জানলাম তৌহিদের উদ্যোগে উনাকে হলিক্রিসেন্ট থেকে আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল রোগীর ট্রিটমেন্ট করা দূরের কথা, খাবারই দিতে পারলো না। এটা কেমন হাসপাতাল। আইসোলেশনে থাকা রোগীর খাবার বাইরে থেকেতো দেওয়ার সুযোগই নেই। তারা রোগী এনে তামাশা করছে। আসলে গোটা চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবা নিয়েই তামাশা চলছে। এসবের প্রতিকার করারও যেন কেউ নেই।’

এ বিষয়ে তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাজী সালেহ উদ্দিন স্যারের কল পেয়ে আমি উনাকে দেখতে যাই। হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের ৯ নম্বর কেবিনে তিনি ছিলেন। গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিন দিন ধরে এই ভদ্রলোক শুধু পানি আর বিস্কিট খেয়ে আছেন। বাথরুমে ময়লাযুক্ত পানি উপচে পড়ছে। এই হাসপাতালে নার্স ২ জন, একজন ডাক্তার আছেন। তারা কেউ রুম থেকে বের হয় না। এমনকি পানি খাওয়ার জন্য একটা গ্লাস চেয়েও পাননি মঈনুল ইসলাম সাহেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘হলি ক্রিসেন্ট একটি হাসপাতাল না, এটি একটি মৃত্যুকূপ! এখানে স্বজনহীন যে কেউ করোনায় মারা যাবার আগে না খেয়ে মারা যাবে।’

এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কভিড ইউনিট-২ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। গত ২১ মে এটি উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আজম নাছির উদ্দিন। হাসপাতালটিতে সরকারিভাবে চিকিৎসক, নার্স ও জনবল কাজ করবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। উদ্বোধনের আগে জানানো হয় ২০ জন চিকিৎসক এ হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। একজন সহকারী পরিচালক বা তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হাসপাতালটি পরিচালিত হবে। পর্যায়ক্রমে আরও ওয়ার্ডবয়, নার্স, স্টাফ নিয়োগ দেওয়ারও ঘোষণা দেওয়া হয়।

এটি উদ্বোধনের সময় চট্টগ্রামের বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় ও জেলা স্বাস্থ্য প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, প্রাইভেট ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!