হঠাৎ থেমে চট্টগ্রামে আবার বেড়েছে ডেঙ্গু, সপ্তাহের বলি ৩

‘দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ’—কবি নজরুলের কবিতার মতই ডেঙ্গুর দেনা বেড়েছে। তাই ঋণের বোঝা কমাতে মৃত্যুর দুয়ারে মিছিল বাড়ছে, তবে তা ধীরে ধীরে। ৩১ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে নগরীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন। এদিকে কীটতত্ত্ববিদ বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা জানানো হলেও সচেতনতার কাজে ভাটা পড়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

বর্ষা মৌসুম এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও চলতি বছরের রেকর্ড গত তিন বছরকে ছাড়িয়ে গেছে। এই সংখ্যাটা হাজার ছাড়ালেও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষ। নিভু আলোর মতো নিভে যেতে যেতে হঠাৎ করে ঝরে যেতে শুরু করেছে প্রাণ। এ বছরের মার্চে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার আভাস দেওয়া হলে প্রথম দিকে কর্তৃপক্ষ কিছুটা সরব থাকলেও দিন যেতে যেতে আবার নেমে এসেছে নীরবতা।

হঠাৎ থেমে গিয়ে ঝড় তোলার মতোই শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রোগীর মৃত্যু হয়। এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিপ্লব দাশ (২৫) নামে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত একজনের মৃত্যু হয়। এবং গত ৩১ আগস্ট নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাদশা মোল্লা (৫৬) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়।

ডেঙ্গুর আভাস-পূর্বাভাস থাকলেও ক্রমেই বাড়ছে উদ্বেগ কিন্তু টনক নড়ে না ওপরমহলের। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, ডেঙ্গু সচেতনতার কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু থিতু হয়ে গেছে নাগরিক উদ্যোগ। ভাটা পড়েছে সচেতনতায়। আগের মতন হাঁকডাক নেই কর্তাবাবুদের। যেন ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে নগরবাসীর মনে অনেকটা সয়ে গেছে। তাই তোলপাড় নেই এই মৃত্যুতে। নীরব ভূমিকা সকলের।

সচেতন নাগরিকের কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও ‘ঢাকায় বেশি চট্টগ্রামে নেই’—এই ভাবনায় থেমে রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব মহলই। তার ওপর গত দুই বছরেও হয়নি মশক জরিপ। এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নগরীর ৪১ ওয়ার্ডে ক্রাশ প্রোগ্রাম, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং করলেও তার কিছুই জানে না ঘুমন্ত নগরবাসী।

জামালখান ওয়ার্ডের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা আতিকুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব নানামুখী উদ্যোগ কেবল টিভি আর পত্রিকার পাতায় দেখি। চোখে দেখি না! আমার বাড়ি পরিস্কার হলে কী হবে? নির্মাণাধীন ভবন, ড্রেন বা আশেপাশের পরিবেশ পরিস্কারের দায়িত্ব কার? বুঝছেন, ফগার মেশিনের ধোঁয়া নাকের ডগায় ঝুলে আছে তাই আমরা সাধারণ মানুষেরা দেখতে পাই না। এসব বলতেও মন চায় না আর।’

শিক্ষিকা শামীমা জেসমিন বলেন, ‘লিফলেটের কথা ডেঙ্গু নিয়ে মাতামাতির সময় একবার শুনেছিলাম। তবে আমি কখনও হাতে পাইনি। আমি হাফবেলা না থাকলেও সারাদিন বাসায় থাকি। কই এসব সচেতনতামূলক লিফলেট তো পাইনি।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে কলেজ শিক্ষার্থী মীম আফরোজ বলেন, ‘এডিস তো এলিট মশা। যদি তেনাদের পরিবারের কেউ মারা যেত তাহলেই কষ্টটা বুঝতে পারতো। যার যায় সেই বোঝে। উনাদের তাতে কি!’

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কীটতত্ত্ববিদরা শুরু থেকেই জানিয়েছেন বাংলাদেশে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। সেটা যে বরাবরই সত্যি, তা পরিস্থিতি দেখিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এখানকার সংশ্লিষ্ট কর্মব্যক্তিরা ঢাকার পরিস্থিতি দেখে যেভাবে ‘আমরা এলার্ট আছি, সচেতন আছি’ বলে হৈচৈ করেছিল, সেভাবে কাজ করেনি। সচেতনতার স্বাক্ষর রাখার জন্য যত না প্রচার প্রচারণার দিকে জোর দিয়েছে, করণীয় বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে করেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষজ্ঞদের কথা আমলে না নেওয়ার কারণে পরিস্থিতিটা ঘটেছে এবং আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি বলবো যে, এটা সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের (বিভাগ) চরম একটা ব্যর্থতা। এখনও সুযোগ আছে। শৈথিল্য না দেখিয়ে আমলে নিয়ে কাজ করা। না হলে অসংখ্য প্রাণ ঝরে যেতে পারে, যা রক্ষা করা যেতে পারতো একটু সচেতন হলেই।’

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত দুই বছরে কোনো জরিপ চালানো হয়নি। তাই কোন্ জায়গায় মশার অস্তিত্ব বেশি তা জানা নেই আমাদের। আসলে জরিপ করার জন্য অতো লোকবলও আমাদের নেই। তাই ঢাকার অপেক্ষায় আছি।’

সিভিল সার্জন ডা.আজিজুর রহমান সিদ্দিকী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকার মতো মহামারি আকার আমাদের এইখানে হয়নি। তারপরও আমরা সচেতন আছি। ঢাকা থেকে টিম এলে খুব তাড়াতাড়ি মশক জরিপটা করা হবে।’

এদিকে ডেঙ্গু সচেতনতায় চসিকের কার্যক্রম নিয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা.সেলিম আকতার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং থাকবে। এখনও লিফলেট বিতরণ, ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে অনেকটা নির্ভর করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। তবে ঢাকার মতো অবস্থা আমাদের এখানে নেই। খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!