স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাককে গুলিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে যেভাবে মারা যায় রোগীরা

পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের স্ট্রোক বেশি হচ্ছে

স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক— দুটো একেবারেই আলাদা ধরনের হলেও একই ভেবে গুলিয়ে ফেলছেন রোগীরা। কারণ স্ট্রোক মস্তিস্কের সমস্যা। অনেকে ভুলে হার্ট অ্যাটাকের সাথে এ রোগকে মিলিয়ে ফেলেন। ফলে ভুল জায়গায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়েন রোগীরা। তৈরি হয় গুরুতর মৃত্যুঝুঁকি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নং নিউরোসার্জাারি ও ১৮ নং নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডে যেসব স্ট্রোকের রোগী আসেন, তারা এক থেকে দুইদিন কিংবা তারও বেশি সময় ১২ নং সিসিইউ ওয়ার্ড বা মেডিসিন ওয়ার্ডে অবস্থান করে সেখানে আসেন। এতে ভুল রোগীতে সিসিইউ (কার্ডিয়াক/করোনারি কেয়ার ইউনিট) রোগীর চাপ বেড়ে যায়। আর এসব রোগীদের বেশিরভাগকেই যখন ১২ থেকে ১৮ ও ২৮ নং ওয়ার্ডে রেফার্ড করা হয়, তখন সেইসব রোগীদের চিকিৎসার জরুরি সময়টুকু পার হয়ে যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নং নিউরোসার্জাারি ও ১৮ নং নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডে যেসব স্ট্রোকের রোগী আসেন, তারা এক থেকে দুইদিন কিংবা তারও বেশি সময় ১২ নং সিসিইউ ওয়ার্ড বা মেডিসিন ওয়ার্ডে অবস্থান করে সেখানে আসেন। এতে ভুল রোগীতে সিসিইউ (কার্ডিয়াক/করোনারি কেয়ার ইউনিট) রোগীর চাপ বেড়ে যায়। আর এসব রোগীদের বেশিরভাগকেই যখন ১২ থেকে ১৮ ও ২৮ নং ওয়ার্ডে রেফার্ড করা হয়, তখন সেইসব রোগীদের চিকিৎসার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যায়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নং নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা ৪৫। সোমবার (২২ নভেম্বর) সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৪১ জন। চিকিৎসাধীনসহ সবমিলিয়ে মোট রোগীর সংখ্যা ১৭৬ জন। সেখানে নির্ধারিত বেডের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। ওইদিনই ওয়ার্ডটিতে রোগী মারা গেছেন চারজন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ক্লিনিক্যাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নোমান খালেদ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই আমাদের সমাজে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। এর মধ্যে একটি ভুল ধারণা হচ্ছে মানুষ আসলে স্ট্রোক বলতে হার্ট অ্যাটাককে বোঝে। সাধারণত হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক দুটো আলাদা জিনিস। কেউ যদি প্যারালাইসিস হয় বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত কিংবা অজ্ঞান হয়ে যায়, অনেকে মনে করে এগুলো হার্ট অ্যাটাক। তাকে তখন হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে হৃদরোগ ওয়ার্ডে ভতি করানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘হৃদরোগের রোগীরা সাধারণত বুকে ব্যথা নিয়ে আসে। তাদের বুকে ব্যথার সঙ্গে হয়তো শরীর ঘেমে যায়। বমি হতে পারে, কিছুটা অজ্ঞানের মতো অবস্থা হতে পারে। মূলত বুকে ব্যথা নিয়ে রোগটা প্রকাশ হয়। শ্বাসকষ্টও হতে পারে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস— এ ধরনের ঝুঁকির বিষয় থাকে, আবার ধূমপানও করে— হয়তো সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত। তাকে হৃদরোগ ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে হবে।’

দুই অসুখের তফাৎ বোঝাতে গিয়ে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ‘স্ট্রোক হল মস্তিষ্কের অসুখ এবং হার্ট অ্যাটাক হল হার্টের অসুখ। যদিও সাধারণত ঝুঁকিগুলো একই রকম থাকে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যারা ওষুধপত্র ঠিকমতো নেয় না, ডায়াবেটিস রয়েছে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করে না—এ ধরনের রোগী যারা ধূমপান করে, তারা কোনো কারণে যদি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়, প্যারালাইসিসের মতো হয়ে যায়, তখন ধারণা করা যেতে পারে তার হয়তো স্ট্রোক হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের নিউরো মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। যদি মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়, তবে তাকে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে ভরতি করাতে হবে।’

অধ্যাপক নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘অনেকেই হার্ট অ্যাটাক হলে ভাবেন— স্ট্রোক হয়েছে। আবার স্ট্রোক হলে ভাবেন— হার্টের কোনো সমস্যা হয়েছে। আসলে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক সম্পূর্ণ ভিন্ন রোগ। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ এবং হার্ট অ্যাটাক হৃদপিণ্ডের রোগ।’

তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে ব্রেইনের নার্ভ কোষে রক্ত সরবরাহ কমে গেলে বা ব্রেইনে যখন কোনো আঘাত হয় বা ব্রেইনের জন্য প্যারালাইসিস হয়, রক্তনালী বন্ধ হয়ে যায় বা রক্তক্ষরণ হয় তখন এটাকে ব্রেইন স্ট্রোক বলে।’

ব্রেইন স্ট্রোকের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের স্ট্রোক বেশি হয়। স্ট্রোকের বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে, যেমন—উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বেশি বয়স, ধূমপান, হৃদপিণ্ডের নানাবিধ সমস্যা, মস্তিষ্কের রক্তনালী সরু হয়ে যাওয়া, অ্যালকোহল, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল ইত্যাদি। আর ব্রেইন স্ট্রোকের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে হঠাৎ করে মুখ-হাত-পা, বিশেষত শরীরের এক পাশে দুর্বলতা বা অচল অনুভূত হয়। এছাড়া হঠাৎ করে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া, কথা বলা বা কথা বুঝতে সমস্যা হওয়া, কথা জড়িয়ে গেছে বা মুখটা একটু বাঁকা হয়ে যাওয়া, হঠাৎ করে চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া বা ঝাপসা দেখা, হঠাৎ করে হাঁটতে সমস্যা হওয়া, মাথা ঘোরা বা শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, কোনো কারণ ছাড়াই প্রচণ্ড মাথাব্যথা— এই ধরনের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলে বা দেখা গেলে বুঝতে হবে ব্রেইন স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক হয়েছে।’

অন্যদিকে হার্ট অ্যাটাক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘হৃদপিণ্ডের কোষে রক্ত সরবরাহ না পেয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়াই হার্ট অ্যাটাক। একিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এবং আনস্ট্র্যাবল অ্যানজাইনায় এ রকম জটিল অবস্থা তৈরি হয়। এর অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসিক চাপ ইত্যাদি। আবার অনেক সময় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে করোনারি রক্তনালি ব্লক হয়ে জায়গাটি বন্ধ হয়ে যায়।’

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় হার্ট অ্যাটাকে বুকের মাঝখানে চাপ বোধ হয়— যা কয়েক মিনিটের বেশি সময় ধরে থাকে। ব্যথাটা মাঝেমধ্যে চলে যায়, আবার ফিরে আসে। একটা অস্বস্তিকর চাপ ও ঝাঁকুনি অনুভব হয়। অনেক সময় বাহু, পিঠে, ঘাড়ে, চোয়ালে অথবা পাকস্থলীতেও অস্বস্তি অনুভব হয়। অনেক সময় বুকে অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস ছোট হয়ে আসে বা শ্বাসকষ্ট হয়। ঘাম দিয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়, বমি বমি ভাব বা হালকা মাথাব্যাথা হতে পারে। এমনকি কিছুটা অজ্ঞানের মতো হতে পারে।’

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলো পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে আলাদা রকমের হয়ে থাকে জানিয়ে ডা. নোমান খালেদ বলেন, ‘পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ হলো বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি। তবে পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে অন্য লক্ষণগুলো বেশি দেখা যায়— যেমন ছোট শ্বাস, বমি বমি ভাব, পিঠে বা চোয়ালে ব্যথা।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!