স্ট্রোকে মৃত্যু— তবু লাশ নিল না বাঁশখালী, ফিরিয়ে দিল চট্টগ্রামের শ্মশানও

বুধ থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাত পর্যন্ত লাশ নিয়ে ছোটাছুটি

চট্টগ্রামে ‘মাইল্ড স্ট্রোকে’ মারা যাওয়া এক ব্যক্তিকে দাহ করতে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছে মৃতের পরিবারের সদস্যরা। শহরে মৃত্যুর পর বাঁশখালীতে তার গ্রামের বাড়িতে তাকে দাহ করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও প্রতিবেশীদের বাধা ও হুমকির মুখে মাঝপথ থেকেই লাশ নিয়ে শহরে ফিরে আসতে হয়েছে স্বজনদের।

পরে শহরে আরও একটি শ্মশানে গিয়ে দাহ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তৃতীয় চেষ্টায় কাট্টলী মহাশ্মশানে তার দাহ সম্পন্ন করে স্বজনরা। বুধবার রাত ১০টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টা পর্যন্ত লাশ নিয়ে ছোটাছুটি করা ওই পরিবারটির সাথে ছিল আল মানাহিল নামে একটি সংগঠন।

জানা গেছে মদন কান্তি সুশীল মুন্না (৫০) পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার এলাকায় বসবাস করতেন। বুধবার (২৪ জুন) রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ইউএসটিসি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। কর্তব্যরত চিকিৎসক তার পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন ‘মাইল্ড স্ট্রোকের’ কারণে মুন্নার মৃত্যু হয়েছে।

স্ট্রোকে মৃত্যু— তবু লাশ নিল না বাঁশখালী, ফিরিয়ে দিল চট্টগ্রামের শ্মশানও 1

মৃত্যুর পর মুন্নার গ্রাম বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নের শীলপাড়ায় তাকে দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয় তার পরিবারের সদস্যরা। আল মানাহিলের সাথে যোগাযোগ করলে তাদের একটি টিম মুন্নার লাশ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাঁশখালীর উদ্দেশ্যে রওনা করে। মাঝপথে গিয়ে তারা জানতে পারেন প্রতিবেশীদের পক্ষ থেকে নানান হুমকি ও বাধা দেয়া হচ্ছে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুন্নার ছেলে অসীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আনোয়ারা অতিক্রম করবো— এমন অবস্থায় আমার জেঠু আমাকে কল করে জানান আমাদের প্রতিবেশীরা বাধা দিচ্ছে। তারা শ্মশানে বেড়া দিয়ে দিয়েছে। বলেছে গ্রামে লাশ নিলে তারা আমাদের ঘরে আগুন দেবে।’

‘আমি বলেছিলাম গ্রামের শ্মশানে বাবাকে দাহ করবো না। আমাদের নিজস্ব জায়গাতে দাহ করবো। তবু তারা অনড় ছিল। তারা বলেছে গ্রামে করোনা আক্রান্ত কারও লাশ ঢোকালে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেবে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এসব কথা আমাদের প্রতিবেশীরাই বলছিল। বরং থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন তারা সব রকমের সহযোগিতা করবেন। আমরা যেন লাশ নিয়ে যাই’— বলেন অসীম কুমার।

‘কিন্তু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে উপর্যুপরি হুমকি পেয়ে আমি ভয় পেয়ে যাই। ফলে মাঝপথ থেকেই আমরা শহরে ফিরে আসি। রাতের ১টার দিকে যাই চাক্তাই এলাকার বলুয়ারদীঘি মহাশ্মশানে। কিন্তু আব্বুর ডেথ সার্টিফিকেট না থাকায় তারাও লাশ দাহ করতে রাজি হয়নি। পরে আমরা জেনারেল হাসপাতালে যাই লাশ নিয়ে। সেখান মানাহিলের সদস্যরা লাশকে দাহের জন্য প্রস্তুত করতে সহযোগিতা করেন আমাদের। এরপর আমরা চলে যাই উত্তর কাট্টলী শ্মশানে। ভোর ৪টার দিকে সেখানে আমরা আব্বুর লাশ দাহ করি।’

স্ট্রোকে মৃত্যু— তবু লাশ নিল না বাঁশখালী, ফিরিয়ে দিল চট্টগ্রামের শ্মশানও 2

অসীম কুমার সুশীল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার আব্বুর করোনার কোন উপসর্গ ছিল না। তিনি মূলত স্ট্রোক করে মারা গেছেন। আর করোনায় মারা গেলেও সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী লাশ থেকে করোনা ছড়ায় না। অথচ পিতার লাশ নিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে তা খুব ভয়ংকর। আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো পৈত্রিক ভিটায় আমি আমার পিতাকে দাহ করতে পারিনি।’

পুরো সময়ে পাশে থেকে সহযোগিতা করায় আল মানাহিলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আল মানাহিল যেভাবে আমাদের পাশে থেকেছে সত্যিই তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই আমার। এই বিপদের দিনে তারা আমার সবার চেয়ে কাছের স্বজন হয়ে ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের পাশে থেকেছে।’

বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘উনারা আমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা বলেছি লাশ দাহ করার ক্ষেত্রে সবরকম সহযোগিতা আমরা করবো। পরে তারা সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করলেন। কেউ বাধা দিয়েছেন— এমন অভিযোগ আমাদের কাছে করেননি। করলে আমরা অবশ্যই এই বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!