সৌরভ নিখোঁজের নয় দিন/ ফেসবুক লাইভে রহস্যের উত্তর খুঁজলেন সোহেল তাজ
অপহরণের নয়দিন পরেও নিজের মামাতো বোনের ছেলে ইফতেখার আলম প্রকাশের (সৌরভ) সন্ধান না পাওয়ায় সংবাদ সম্মেলনের পর এবার ফেসবুক লাইভে আসলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। মঙ্গলবার (১৮ জুন) সন্ধ্যা ৬ টায় মামাতো বোন ইয়াসমিন (নিখোঁজ সৌরভের মা) ও তার স্বামী মানিককে (নিখোঁজ সৌরভের বাবা) সঙ্গে নিয়ে ফেসবুক লাইভে আসেন সোহেল তাজ।
১৮ মিনিটের ফেসবুক লাইভের শুরুতে সোহেল তাজ সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার মামাতো বোনের ছেলে সৌরভ গত ৯ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে। আমি সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি ছেলেটিকে অক্ষত, সুস্থ ও জীবিত ফিরে পাওয়ার জন্য। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেই তদন্ত করব এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তথ্য সরবরাহ করব। এই বলে তিনি ফেসবুকে লাইভে আসার পূর্বেই একটা স্ট্যাটাসে জানান। ফেসবুক লাইভের কথোপকথনে পাওয়া গেছে বেশকিছু তথ্য। সেগুলোই নিচে তুলে ধরা হল-
সোহেল তাজ: মানিক ভাই (সৌরভের বাবা) আপনার সঙ্গে কি পুলিশ যোগাযোগ করেছে?
মানিক: আমার সঙ্গে থানা থেকে কোন যোগাযোগ করা হয়নি, আমি নিজে থেকেই যোগাযোগ করেছি। তখন ফোনে ওসি সাহেব (চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা) আমাকে বলেন, আপনারা কোথাও থেকে কোনো ধরনের তথ্য পেয়েছেন কিনা? তখন আমি বললাম, আমরা তো কোনো তথ্য পাইনি। পরে একপর্যায়ে আমি ওসিকে বলাম, সমস্ত ফুটেজ থেকে শুরু করে সবকিছু তো আপনাদের কাছে আছে।
সোহেল তাজ: ফুটেজে কী দেখা যায়?
মানিক: ফুটেজে দেখা যায় ৬টা কত মিনিটে আমার ছেলে আগোরার সুপার মার্কেটের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এরপর তার সঙ্গে অপহরণকারীদের সাথে যোগাযোগ হয়।
সোহেল তাজ: সৌরভকে ৯ জুন আপনার জানামতে কে ফোন করে ছিল?
মানিক: এই ফোনটা ঢাকা থেকে করা হয়েছিল। যারা ঢাকা থেকে রমজান মাসে আমার ছেলেকে বনানীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে একদিন রেখে বনানীর বাসায় রাতে দিয়ে গিয়েছিল।
সোহেল তাজ: বনানীর বাসায় যারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারা কী পরিচয় দিয়েছিল?
মানিক: তারা র্যাব-১ এর পরিচয় দিয়েছিল। এ সময় একটি কাগজও দিয়েছিল আমাদের।
সোহেল তাজ: আচ্ছা তার মানে মে মাসে সৌরভকে তুলে নিয়ে যায় ২৪ ঘণ্টার জন্য। ফিরিয়ে দেওয়ার সময় একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছিল। আর সেই কাগজটি র্যাব-১ এর প্রাপ্তি স্বীকার ফরম ছিল।
মানিক: উনারা তখন বলেন, সে সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হয়েছে সব মিথ্যা।
সোহেল তাজ: ইয়াসমিন আপা আপনাকে কী বলে গিয়েছিল সৌরভ?
ইয়াসমিন: সৌরভ যাওয়ার সময় বলে, মা আমার কাছে তারা (র্যাব-১) সার্টিফিকেট চেয়েছে।
সোহেল তাজ: ‘আপনি জিজ্ঞাস করেছিলেন কে সার্টিফিকেট চেয়েছে?
ইয়াসমিন: ‘হ্যাঁ জিজ্ঞাস করেছি। যারা তাকে এর আগে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারা সৌরভকে বলেছে, তোমার তো কোনো দোষ নেই, আমরা যদি তোমাকে একটা ভালো জায়গা প্রোভাইড করি।
তখন সৌরভ বলেছিল তাদের, আপনারা যা প্রয়োজন করেন তবুও এই যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করেন।
সোহেল তাজ: ‘তার মানে আপনাকে মূলত সৌরভ বলে গিয়েছে যে, ঐ যে মে মাসে যারা উঠিয়ে নিয়েছিল তারাই তাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছে।
ইয়াসমিন: সৌরভকে নাকি চোখ বাঁধা অবস্থায় জিজ্ঞাস করেছিল, আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কিভাবে? তখন সৌরভকে তারা বলেছে, তোমার যোগাযোগ করতে হবে না, আমরাই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। সৌরভ আরও বলেছে, তারা প্রত্যেকে ইংলিশে কথা বলছিল, প্রত্যেকে শিক্ষিত ও তাদের কাছে ওয়াকিটকি ও আর্মস ছিল।
সোহেল তাজ: সৌরভকে আগে যখন উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তখন তার মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে তাকে নেওয়া হয়েছিল। আমরা জানি আমাদের এলিট ফোর্সেস ছাড়া কারও কাছে এই মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং প্রযুক্তি নেই।
সর্বশেষ ইয়াসমিন বলেন, ‘যেদিন সৌরভ গুম হলো, এর একদিন আগে আবার সেই নম্বর থেকে সৌরভের কাছে কল আসে। তখন তাকে সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে বলে তারা চাকরি দেবে বলে। তখন সৌরভ বলে, আমার মা অসুস্থ আজ পারব না। তখন তারা আবার ফোন করে বলে, আমাদের দুইজন অফিসার তোমার সঙ্গে বসবে। তাদের কাছে তুমি তোমার পাসপোর্টে ও এনআইডি কার্ডের ফটোকপি দিয়ে আসবে। পরে সৌরভ পার্সপোর্ট ও এনআইডি কার্ড ফটোকপি করতে গেলে গুম হয়ে যায়।
যেভাবে নিখোঁজ হয়ে যান সৌরভ
সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ রোববার ৯ জুন চট্টগ্রাম প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার সামনে থেকে নিখোঁজ হন। তবে সৌরভের বাবা ইদ্রিস আলম বাদি হয়ে ১০ জুন সোমবার পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডি (৫২০) দায়ের করেছেন। জিডিতে তিনি সৌরভকে অপহরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ওইদিন চাচাতো ভাইয়ের মোটর বাইকে চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার সামনে আসেন সোহেল তাজের ভাগ্নে সৈয়দ ইফতেখার আলম সৌরভ। সেখান থেকে নিখোঁজ হন তিনি। সৌরভের বাবা ইদ্রিস হোসেন বাদি হয়ে পরদিন সোমবার পাঁচলাইশ থানায় একটি জিডি করেছেন। জিডিতে তিনি সৌরভকে অপহরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
প্রবর্তক মোড়ের আফমি প্লাজার নিচতলায় অবস্থিত এগোরা সুপারশপের সিসি ক্যামেরায় সৌরভের অবস্থান দেখা গেছে। পাঁচ মিনিট পর একটি কল রিসিভ করে এফমি প্লাজার পেছনে যান সৌরভ। এখান থেকেই পাঁচ ব্যক্তি কালো প্রাডোতে তুলে অন্যত্র নিয়ে যান সৌরভকে। এসময় সৌরভের হাতে একটি সাদা খাম ছিল।
সৌরভের চাচাতো ভাই সাহেদুর রহমান জানান, হাতে থাকা খামে সৌরভের সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) ছিল। চাকরি দেওয়ার কথা বলে সৌরভকে ডাকা হয়েছিল। চাচাতো ভাই সাহেদুরই সৌরভকে মোটরসাইকেলে এনে আফমি প্লাজার সামনে নামিয়ে দেন। তখন সৌরভ তাকে জানিয়েছিলেন, ১০-১৫ মিনিট পরে আবার ফোন করবেন, তখন এসে তাকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ১৫ মিনিট পরে আর ফোন করেননি সৌরভ। কল দিলে মোবাইল বন্ধ পান সাহেদুর।
সৌরভের বড় ভাই তানভির শাহরিয়ার সম্রাট বলেন, সিসি ক্যামেরায় সৌরভকে নিয়ে যাওয়ার ফুটেজ আছে। কালো প্রাডো গাড়িটি কার সেটি বের করলেই জানা যাবে সৌরভের অবস্থান। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই আমাদের ভয় বাড়ছে।