সোলায়মান শেঠ/ ওয়াসায় গ্রাহক প্রতিনিধি সেজে এমডি ও ঠিকাদারের স্বার্থ দেখাই তার কাজ!

চার বছর ধরে অবৈধভাবে চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ড সদস্যের পদ দখল করে আছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠ। গ্রাহক প্রতিনিধি কোটায় স্থানীয় সরকার বিভাগ তাকে ২০১২ সালে নিয়োগ দিলেও সেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে চার বছর আগে, ২০১৫ সালে। মেয়াদ পূর্তির চার বছর পার হলেও কেন তাকে ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে বহাল রাখা হলো এ নিয়ে খোদ ওয়াসার বোর্ডেই রয়েছে ক্ষোভ।

solaiman-alam-seth
বারেবারেই সমালোচিত সোলায়মান আলম শেঠ
‘গ্রাহক প্রতিনিধি’ হিসেবে বারেবারেই সমালোচিত সোলায়মান আলম শেঠ ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হলেও গ্রাহক স্বার্থের ধার ধারেন না তিনি—এমন অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। উল্টো তিনি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের স্বার্থ রক্ষা, অনৈতিক ফায়দা হাসিলসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গাইতে ওয়াসা বোর্ড সদস্যের পদ দখল করে আছে বলে অভিযোগ বোর্ডের অন্য সদস্যদের। গ্রাহকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ক্যাব) বলছে, গ্রাহকদের কোন স্বার্থই দেখেন না শেঠ। অবৈধভাবে পদ আঁকড়ে থেকে ওয়াসার এমডি এবং ঠিকাদারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই তার একমাত্র কাজ।

চট্টগ্রাম ওয়াসা সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপসচিব শাসম উদ্দিন আহমদ ২০১২ সালের ৩০ মে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন সোলায়মান আলম শেঠকে।

তিন বছর মেয়াদে সোলায়মান আলম শেঠের মেয়াদ শেষ হলে পুনরায় ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন উপ সচিব ঈশান আলী রাজা বাঙ্গালী পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পাঠানোর জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) নিদের্শনা দেন।

ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, ওয়াসার গ্রাহক প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে গ্রাহক সমাবেশ ডেকে গ্রাহকদের মতামত নেওয়ার বিধান রয়েছে। সেই সভায় গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিরও বিধান রয়েছে। অথচ এসব নিয়ম না মেনে ওয়াসার এমডি একেএম ফজলুল্লাহ গত ২১ সেপ্টেম্বর পুনরায় গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর সোলায়মান আলম শেঠসহ দুজনের নাম পাঠান।

চট্টগ্রাম ওয়াসার একজন বোর্ড সদস্য জানান, গ্রাহক প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে কিছু বিধিবিধান রয়েছে। সোলায়মান আলম শেঠকে ২০১২ সালে গ্রাহক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময়ও সেই বিধিবিধানগুলো মানা হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন পুনরায় সোলায়মান আলম শেঠের নাম পাঠানো হয় তখনও সেই বিধান মানা হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে মন্ত্রণালয় নতুন করে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। আর এর সুযোগ নিয়েছেন ওয়াসার এমডি।

ওয়াসা বোর্ডে গ্রাহকদের স্বার্থ নিয়ে কোন কথা না বলে ওয়াসা এমডি ও ঠিকাদারদের সাথে আঁতাত করে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াসার বোর্ড সভায় সদস্যরা প্রশ্ন তুললেই তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন সোলায়মান আলম শেঠ। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে ওয়াসার ৫১তম বোর্ড সভায়। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ওয়াসার বোর্ড সদস্য সাংবাদিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী তার বক্তব্যে ওয়াসা বোর্ডের গ্রাহক প্রতিনিধি সদস্য সোলায়মান আলম শেঠের অবৈধ নিয়োগ, গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ না করে উল্টো গ্রাহকদের স্বার্থ পরিপন্থী কাজে জড়িত থাকার বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিলে সোলায়মান আলম শেঠ উত্তেজিত হয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন।

চট্টগ্রাম ওয়াসার বোর্ড সদস্য মহসিন কাজী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে সোলায়মান আলম শেঠের কোন বৈধতা নেই। কারণ তার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। শুধুমাত্র ওয়াসা এমডি এবং ঠিকাদারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য তাকে নিয়মবহির্ভুতভাবে এই পদে রাখা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ওয়াসা এমডির বেতন ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করে ওয়াসা বোর্ড। সেই প্রেক্ষাপটে তিনি কিভাবে বোর্ড সদস্য মনোনীত করবেন? তিনি আইনের বাত্যয় ঘটিয়ে প্রথম দফায় সোলায়মান আলম শেঠের নাম পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়েও গ্রাহক প্রতিনিধি নির্বাচনের নিয়ম না মেনে মন্ত্রণালয়ে তার নাম পাঠান।

ওয়াসার বোর্ড সদস্য মহসিন কাজী আরো বলেন, একজন গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গ্রাহকদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া দুঃখজনক। উল্টো গ্রাহকদের সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বোর্ডসভায় কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়াও অপমানজনক।

এদিকে গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী সংগঠন ক্যাবের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ওয়াসার বোর্ডে গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে সোলায়মান আলম শেঠের অন্তর্ভূক্তি সম্পূর্ণ অবৈধ। ওয়াসা এমডি এবং দূর্নীতিবাজ ঠিকাদারদর অনৈতিক কাজের বৈধতা দেওয়া ছাড়া তার কোন কাজ নেই। ওয়াসা বোর্ডে গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে সোলায়মান আলম শেঠের সম্পৃক্ততাকে অবৈধ উল্লেখ করে এসএম নাজের হোসেন বলেন, এটি অনিয়ম এবং চরম দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

সোলায়মান আলম শেঠ ওয়াসার বোর্ড সদস্য হিসেবে তার অন্তর্ভূক্তির প্রসঙ্গটি আনতেই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এই প্রতিবেদককে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোনো জিনিস আর কতো বলব। ওয়াসার একজন বোর্ড সদস্যকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এক ছোট লোক এসব সংবাদ পরিবেশন করাচ্ছে। তিনি কিভাবে ওয়াসার বোর্ড সদস্য তা জানতে প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন।’

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কেএম ফজলুল্লাহ বলেন, সোলায়মান আলম শেঠ কিভাবে ওয়াসার বোর্ড সদস্য তা সরকার বলতে পারবে। কারণ তার মেয়াদপূর্তির পর দুজনের নাম পাঠানো হয় ২০১৫ সালে। এরপর কোন নির্দেশনা যেহেতু আসেনি, তাই আগের নিয়োগ অনুযায়ী সোলায়মান আলম শেঠই বহাল আছেন।’

ওয়াসা বোর্ডে সোলায়মান আলম শেঠকে অনৈতিক সুযোগ দেওয়ার প্রসঙ্গটি তিনি এড়িয়ে যান।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!