সেপটিক ট্যাংকের গ্যাস থেকেই পাথরঘাটার বিস্ফোরণ?

চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য সবার মুখে মুখে গ্যাসলাইনের বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও কোন্ কারণে এ ঘটনা তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকেও এ বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন।

তবে গ্যাসলাইনের রাইজার উদ্ধার করার পর যে সংস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে সেই কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপক (রক্ষণাবেক্ষণ) বলছেন, এই বিস্ফোরণের যে ভায়বহতা এবং রাইজার দেখে জোর দিয়ে বলা যাবে না গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেইফটি ট্যাংকে জমা গ্যাস বিস্ফোরণ থেকেই ভয়াবহ এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে দাবি তাদের। সিডিএর কর্মকর্তারাও বলছেন, ভবনের নিচে থাকা সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণ থেকেই ভয়াবহ এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রসঙ্গত, রোববার (১৭ নভেম্বর) সকালে নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডে বড়ুয়া ভবনের এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে নারী শিশুসহ ৭জন নিহত হন। এ ঘটনায় দগ্ধসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন স্কুল শিক্ষক অ্যানি বড়ুয়া (৪০), গৃহবধূ জুলেখা খানম ফারজানা (৩৩), তার দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ুয়া ৭ বছর বয়সী শিশু আতিকুর রহমান শুভ, রিকশাচালক আব্দুল শুক্কুর (৫০), ভ্যানচালক মো. সেলিম (৪০), পাশের ভবনের রঙ মিস্ত্রি নুরুল ইসলাম (৩১)। এখনও ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির মরদেহ অজ্ঞাত হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।

বিস্ফোরণে ওই ভবনের নিচতলার দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর ধসে রাস্তার উপর পড়লে পথচারীর, রিকশাচালক নিহত ও আহত হয়েছেন। বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এতোই শক্তিশালী ও ভয়াবহ ছিল যে বড়ুয়া ভবনে বিস্ফোরণের কারণে রাস্তার অপর পাশে অবস্থিত জসীম বিল্ডিংয়ের নিচতলার দোকানে গিয়ে পড়ে নিহত ও আহতদের অনেকে। এমনকি সেখানকার কলাপসিবল গেটসহ ভেঙে ওই ভবনের বেশ কিছু দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণের এই ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সিএমপি, কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল) পক্ষ থেকে মোট চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রোববার দুপরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের মহা ব্যবস্থাপক (রক্ষণাবেক্ষণ) সারওয়ার হোসেন বলেছেন, ‘এখানে গ্যাসের কোনও সমস্যা হয়নি। গ্যাসলাইনে ত্রুটি থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যে বাসায় এই বিস্ফোরণ হয়েছে ওই বাসার গ্যাসের চুলাও অক্ষত আছে। আগুন লাগার ঘটনাও বড় আকারে ঘটেনি। গ্যাসের লাইন লিক কিংবা রাইজারের ত্রুটির কারণে ভবনের দেয়াল উড়িয়ে নেওয়ার কথা নয়। ভবনের ভেতর বা পাশে কোনও সেপটিক ট্যাংকে দীর্ঘদিনের জমা গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পর ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’

গ্যাসলাইনের উদ্ধার করা রাইজার
গ্যাসলাইনের উদ্ধার করা রাইজার

এ ঘটনায় কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (রক্ষণাবেক্ষণ) সরওয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিউল আজম, আবু জাহেদ, আহসান হাবিবকে সদস্য করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কেজিডিসিএল। ইতিমধ্যে গ্যাসলাইনে কোনো সমস্যা থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়নি বলে দিনে দিনেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কেজিডিসিএল৤

রোববার বিকেলে পাথরঘাটায় ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণে একটি ধারণা পাওয়া গেছে। পাশের ভবনের বাসিন্দা মো. নাছির হোসেন, কলেজের অধ্যাপক দীপক ধরসহ অনেকেই জানিয়েছেন, বড়ুয়া ভবন ও সীমানা প্রাচরীটিও অনেক পুরনো। রাস্তার সঙ্গে লাগোয়াই সীমান প্রাচীর ঘেষেই ভবনের নিচে ছিল সেপটিক ট্যাংক। বিস্ফোরণের পর সেপটিক ট্যাংকের ঢাকনা দুটিও উড়ে গেছে দেওয়া ও নিচতলার দেওয়ার সঙ্গে। বিশেষ করে বড়ুয়া ভবনের সীমানা প্রাচীর উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল উল্টো দিকের পনের ফুট দূরত্বের জসীম ভবনের নিচতলায়। আর যে বড়ুয়া ভবনের তিন রুম বিস্ফোরণে উড়ে গেছে সেই ভবনের কয়েকজন আহত হলেও কেউ নিহত হননি। তবে বিস্ফোরিত ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়া পথচারী ও জসীম ভবনের দোকেন আসা ৭জন নিহত হয়েছেন। তাদেরও ধারণা ভবনের মত অনেক পুরানো সেপটিক ট্যাংকের জমানো গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেপটিক ট্যাংকের লিকেজ গ্যাসে বড়ুয়া ভবনের নিচতলার বাসিন্দা অর্পিতা নাথ পুজার জন্য ম্যাচ জ্বালাতেই ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরও ধারণা, তিন রুমের বড়ুয়া ভবনের সেপটিক ট্যাংকের জমানো গ্যাসের বিস্ফোরণ না হলে এভাবে ভবনের পাশাপাশি দেয়ালও উপড়ে গেছে।

তবে বিস্ফোরক অরিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন— ‘এখানের রাইজারটা ছিল অধিক পুরানো এবং যে পাইপ লাইনটা ছিল ওটা অতি পুরনো। পাইপ লাইনটা রাবার দিয়ে মোড়ানোর কথা ছিল কিন্তু পাইপ লাইনে রাবার মোড়ানো ছিল না। তাই আমরা ধারণা করছি এই পাইপ লাইনের যেকোনো একটা ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হয়েছে। আমরা যেটা শুনছি, ওই বাসার মহিলা সকালে পূজা দেয়ার জন্য ম্যাচ জ্বালিয়ে ছিলেন। দিয়াশলাই জ্বালানোর সাথে সাথে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণটা এমনভাবে ঘটেছে যা সমস্ত রুমে এক সাথে ঘটছে। আর বিস্ফোরণের মাত্রা এত বেশি শক্তিশালী ছিল যে দুর্বল জায়গাগুলো ভেঙ্গে রাস্তায় গিয়ে পড়েছে।’

বিস্ফোরক অধিদপ্তর ছাড়াও গ্যাস লাইনের লিকেজের কারণে বড়ুয়া ভবনের বিস্ফোরণ বলে প্রাথমিক ধারণা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট কাজ করে। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দীন বলেন, ‘সম্ভবত পাইপ লাইনটি অনেক পুরনো ছিল। গ্যাসের প্রেসার বেশি থাকার কারণে লাইন লিকেজ থেকেই মূলত এই বিস্ফোরণ হতে পারে।’
অন্যদিকে নগরীর ভবনের তদারক সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যে ভবনটিতে এই বিস্ফোরণ। সেই ভবনটি ২০ ফুট রাস্তার ওপর কমপক্ষে ৪-৫ ফুট চলে এসেছে। এছাড়াও রাস্তার সাথেই লাগোয়া ভবনের নিচতলা জুড়ে একটি সেপটিক ট্যাংক রয়েছে। যেটি কোনও নিয়ম মেনেই করা হয়নি। হয়তো এখানে জমানো গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।’

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির নিচে গর্ত বদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকলে তার ভেতর নানা ধরনের ক্ষতিকারক বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ সালফারের অন্যান্য গ্যাস, মিথেন, এমনকী বিষাক্ত কার্বন মোনোক্সাইড তৈরি হতে পারে। বদ্ধ থাকার ফলে এসব গ্যাস ক্রমশ ঘন হতে থাকে, এবং সেই সাথে অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হতে থাকে। কখনো কখনো এ ধরনের বদ্ধ কূপ একেবারে অক্সিজেনশূন্য হয়ে যেতে পারে।

এডি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!