সেন্টমার্টিনে হোটেল-কটেজ উঠছে একের পর এক, সু্প্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞাও মানছে না কেউ

২৪ বছরের মধ্যে পুরোপুরি প্রবালশূন্য হওয়ার শঙ্কা

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল ও কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে। অথচ দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে।

এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ বছর আগে দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙারও নির্দেশ দেন আদালত। সেটা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে সেখানে নতুন করে প্রায় অর্ধশতাধিক পাকা দালান উঠছে সেন্টমার্টিনে। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বখ্যাত দ্বীপটি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, দ্বীপের জেটিঘাট থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে উত্তর সমুদ্র সৈকতের তীরে পশ্চিমপাড়ার অবস্থান। সেখানে ‘নিঝুম বাড়ি’ আবাসিক হোটেলে দোতলার কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। তার আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর।

সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল ও কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে।
সেন্টমার্টিনে নতুন করে অবৈধভাবে আবাসিক হোটেল ও কটেজ নির্মাণের কাজ চলছে।

এভাবে দ্বীপের পূর্বপাড়া, মাঝেরপাড়া ও কোনাপাড়াসহ কয়েকটি পাড়ায় প্রায় অর্ধশতাধিক দালানকোঠা নির্মাণের কাজ চলছে। শুধু তাই নয়, সৈকত সংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। হোটেলে চলা জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে বেড়ে চলেছে শব্দদূষণ।

দ্বীপে অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক, ঝিনুক ও পাথর। যার যেভাবে ইচ্ছা দ্বীপের সব স্থানে ঘুরছেন। পুরো এলাকা যেন নিয়ন্ত্রণহীন। এদিকে ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে— এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে।

এই দ্বীপে প্রবাল ছাড়াও রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কচ্ছপ, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। দ্বীপের বাসিন্দারা জানান, পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে দ্বীপে তাড়াহুড়া করে চলছে নতুন আবাসিক হোটেল নির্মাণের কাজ। তবে কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তর, প্রশাসনসহ সরকারি কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সেন্টমার্টিনদ্বীপে এ সব স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে।

এই চক্রের যোগসাজশে প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণ সামগ্রী পৌঁছে যায় সেন্টমার্টিনদ্বীপে। সংশ্নিষ্ট দপ্তর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণ সামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোনও বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোঁরা। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে।

সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। দ্বীপকে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে আদালত, ফলে নির্দেশনা মতে সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।

দ্বীপে রাস্তাসহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের নামে নিয়ে যাওয়া ইট, বালু, সিমেন্ট ও কংক্রিট দিয়ে সেখানে নতুন করে অবৈধভাবে গড়ে উঠছে অর্ধশতাধিক ছোট-বড় আবাসিক হোটেল ও কটেজ। আইন প্রয়োগ না করার কারণে আজ দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হারিয়ে যাওয়ার পথে।

‘নিঝুম বাড়ি’ আবাসিক হোটেলে নির্মাণের দায়িত্বে থাকা হেলাল উদ্দিন জানান, ‘দ্বীপে ফাইভ স্টার হোটেলসহ অনেক দালানকোঠার নির্মাণকাজ চলছে। দ্বীপে শুধু আমি একা নির্মাণ করছি না, আরও অনেকে দালান নির্মাণ করছেন। বিশাল ভবন নির্মাণ হয়েছে তাতে দ্বীপের ক্ষতি হচ্ছে না, সামান্য এ দালানকোঠা নির্মাণে কী আর ক্ষতি হবে।’

পূর্বপাড়া দালানকোঠা নির্মাণকারী মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘দ্বীপে দেড় শতাধিকের বেশি ছোট-বড় আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মাঝেও অনেকে কটেজ নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা তো কেউ অনুমতি নেননি। তাদের মতো আমি একটি ছোট কটেজ নির্মাণ করছি। এখানে অনুমতির কী আছে?’

কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া কাউকে এখানে দালানকোঠা নির্মাণের জন্য মালপত্র আনতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতি ছাড়া কোনও মালপত্র পেলে সেগুলো জব্দ করা হচ্ছে।’

সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৪টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনার মধ্যেই নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক উল্লেখ করে কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রভাবশালীরা দ্বীপে প্রকাশ্যে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নতুন ভবন নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশপাশি অতি দ্রুত আদালতের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। তা না হলে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘নতুন করে মালপত্র নিয়ে দালানকোঠা নির্মাণের কোনও সুযোগ নেই। সম্প্রতি অবৈধভাবে মালপত্র নেওয়ায় আট জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তবু কেউ যদি দালানকোঠা করে থাকে সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেন্টমার্টিন রক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ নুর আহমদ বলেন, ‘অবৈধভাবে নতুন করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তবু তারা কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষ করে দ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।’

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!