সেই ১১ ডাকাতের দুজন চিকিৎসক শাহ আলমের খুনি!

নিজস্ব গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতি করে বেড়ানো সেই ১১ ডাকাতের দুজন ‘গরিবের চিকিৎসক’ শাহ আলম খুনের সঙ্গে জড়িত।

শনিবার (২ নভেম্বর) ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার টাইগারপাস এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১১ জনের এই ডাকাতদলকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ডাকাতদলের নেতা মো. সালাউদ্দিন (২৪) এবং মো. টিটু (২৫) নামের অপর এক ডাকাত গত ১৭ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের সড়কে চিকিৎসক শাহ আলম হত্যায় সরাসরি জড়িত।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। তিনি জানান, তাদের সম্পর্কে আরও তদন্ত করলে জানা যায়, ১১ জনের এই ডাকাতদলের নেতা মো. সালাউদ্দিন এবং মো. টিটু চিকিৎসক শাহ আলম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। প্রথমে এসব ডাকাতের বিরুদ্ধে মিরসরাই ও আকবর শাহ থানায় বেশ কয়েকটি মামলার কথা জানা গেলেও আরও খোঁজ নিয়ে চিকিৎসক হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে।

আন্তঃজেলা ডাকাতদলের ১১ সদস্যের রয়েছে নিজস্ব গাড়ি, এমনকি ট্রাকও। সেটা ব্যবহার করেই ডাকাতি করে ওরা। ভোরে চট্টগ্রাম নগরে আসা বাস-ট্রেনের যাত্রীরাই তাদের মূল টার্গেট। যাত্রীদের অনুসরণ করে নির্জন জায়গা বুঝে অস্ত্র ও ছুরি ঠেকিয়ে মোবাইল-টাকা ছাড়াও নিয়ে নেয় সঙ্গে থাকা পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। এরপর শুরু হতো আরেক খেলা। মূল্যবান কাগজপত্র ফিরিয়ে দেওয়ার নামে বিকাশে আদায় করে চাঁদা।

চট্টগ্রাম নগরীই নয় শুধু, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ফেনী, কুমিল্লা, লাকসাম ও নোয়াখালী পর্যন্ত ছিল অপতৎপরতা। কিন্তু সবসময় তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর নেপথ্যে রয়েছে ডাকাতদলের অলিখিত এ কঠোর নিয়ম। ডাকাতির প্রতিটি ঘটনার পর পুরো এই ডাকাতদল চলে যায় সীতাকুণ্ডের পাহাড়ের গুহায়। পুলিশি তৎপরতা কমে না যাওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান করে সেই গুহাতে। এ কারণে পুলিশ হিমশিম খেয়ে যায় তাদের হদিস পেতে।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা সম্প্রতি সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে ডাকাতি, নগরীর সাগরিকা এলাকায় মোটর পার্টসের দোকান, ফেনীর মহিপালে কাপড়ের দোকান, ফেনীতে চালের দোকান, চৌদ্দগ্রামে মার্কেট এবং ফেনী, কুমিল্লা, লাকসাম ও নোয়াখালী এলাকায় পিকআপ ভ্যান নিয়ে মহাসড়কে ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা গাড়ি নিয়ে মহাসড়কে ঘুরতো। চলন্ত বাস দাঁড় করিয়ে ডাকাতি করতো। সড়কের পাশে যেসব দোকানের শাটার বা ঘরের তালা ভাঙতে পারবে বলে মনে হত গভীর রাতে সেগুলো ভেঙে ডাকাতি করত।

ডাকাতদলের হাতে চিকিৎসক শাহ আলম হত্যার ঘটনাও ঘটেছে এভাবেই। র‌্যাবসূত্রে জানা যায়, এর সঙ্গে পাঁচজন জড়িত। পাঁচজনের একজন র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নজির আহমেদ সুমন প্রকাশ কালু (২৬) নিহত হয়েছেন। আর একজন লেগুনাচালক ওমর ফারুককে (১৯) গ্রেপ্তার করে। পরে সে আদালত ১৬৪ ধারায় হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় এবং হত্যার সঙ্গে জড়িতদের নাম পরিচয় প্রকাশ করে। ওমর ফারুকের তথ্যমতে ১১ ডাকাতের সালাউদ্দিন ও টিটুও তাদের সদস্য। এখনও একজন পলাতক আছে বলে জানা যায়।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টায় সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা বাইপাস থেকে চিকিৎসক শাহ আলমের ভাগ্নে মো. ইজাব তাকে সেফলাইনের আল মনসুর পরিবহনের একটি লেগুনাতে তুলে দেন। ইজাব ভেবেছিলেন অন্যদিনের মতো তার মামা চান্দগাঁওয়ের বাসায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বাসায় না পৌঁছায় স্ত্রী-সন্তানরা ধরে নিয়েছিল ডা. শাহ আলম সীতাকুণ্ডেই অবস্থান করছেন। পরে শাহ আলমের লাশ পাওয়া যায় সীতাকুণ্ড ঘাটঘর এলাকায়।

শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সকালে স্থানীয়দের দেওয়া সংবাদে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। শুক্রবার রাতে লাশ শনাক্ত হওয়ার পর শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে স্ত্রী-সন্তানরা লাশ গ্রহণ করেন। ওইদিন রাত ১০টায় নিহত শাহ আলমের স্ত্রী বাদি হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

প্রসঙ্গত, নিহত চিকিৎসক শাহ আলম সীতাকুণ্ড কুমিরা ইউনিয়নের ছোট কুমিরার মাস্টার আজিজুল হকের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) থেকে এমবিবিএস শেষ করে চমেকের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল গণি শিকদারের মেয়ে অমরানা আজমিরি শিকদার কান্তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কান্তা নগরীর মরহুম আবু শাহিদ দোভাষের মেয়ের ঘরের নাতনি। শাহ আলম-কান্তার সংসারে দুই পুত্রসন্তান রয়েছে। একজন বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ছেন, অপরজন দশম শ্রেণিতে।

ডা. শাহ আলম দীর্ঘ ৩০ বছর সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডে নিজ গ্রামে শিশুদের জন্য ‘চাইল্ড কেয়ার’ নামে একটি ক্লিনিক চালু করেন।

এইচটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!