সেই শাহজাদার বিরুদ্ধে গরিবের চাল মেরে খাওয়ার নালিশ এবার
অনিয়ম প্রমাণ হলেই ব্যবস্থা— বললেন জেলা প্রশাসক
করোনাভাইরাস উদ্ভুত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে ওএমএস সুবিধাভোগীদের ১০ টাকা কেজি মূল্যে ২০ কেজি করে দুই দফায় ৪০ কেজি চাল সরবরাহ করেছে জেলা প্রশাসন। বোয়ালখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ সকল ডকুমেন্ট যথাসময়ে জমা দিয়ে একবারও চাল পাননি। সুবিধাবঞ্চিতরা কাউন্সিলর শাহজাদা মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে গরিবের জন্য বরাদ্দ করা ১০ টাকায় কেজির চাল আত্মসাতের অভিযোগে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
করোনাভাইরাসে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকার নানাভাবে নিম্ন আয়ের মানুষকে সহযোগিতার যতোগুলো উদ্যোগ নিয়েছে তার মধ্যে একটি হলো ১০ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহ করা। একে ওএমএস বা ওপেন মার্কেট সেল বলা হয়।
জানা গেছে, বোয়ালখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহজাদা মিজানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহযোগিতার টাকা বিতরণে নয়-ছয় করার অভিযোগও উঠেছিল এর আগে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সে অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।
ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা অনন্ত দাশ, নীরমল দাশ, নরউত্তম দাশ পেশায় দিনমজুর। তালিকায় একজনের নাম আছে ৭০, একজনের ৭৩ আর অপরজনের নাম ৭৬ নম্বরে। রঞ্জু দাশের স্বামী সূর্য মোহন আরেক সংসার করে রঞ্জুকে একা রেখে চলে গেছেন। তার নাম আছে তালিকার ৭৮ নম্বরে। আরেক দিনমজুর বিমল দাশের স্ত্রী নিলু দাশের নাম আছে তালিকার ৭২ নম্বরে।
সশরীরে এই পাঁচজনের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, ওদের সবার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওএমএসের চাল সংগ্রহের কোন কার্ড ওই পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়নি। ওই ওয়ার্ডে দুই দফায় ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হলেও এই পরিবারগুলোর ভাগ্যে জোটেনি একমুঠো চাল। তারা বেশ কয়েক দফায় কাউন্সিলর শাহজাদা মিজানের সাথে দেখা করলে তিনি ‘দিচ্ছি-দেবো’ বলে সময় পার করেছেন— এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
চাল না পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তালিকার ১৩৭ নম্বরে মো. লোকমান, ১৩৮ নম্বরে হাসিনা বেগম, ১৪১ নম্বরে আব্দুল কাদের অন্যতম। আবার দুই দফার মধ্যে মাত্র এক দফায় চাল পেয়েছেন যারা— তাদের মধ্যে রয়েছেন তালিকার ৯০ নম্বরে থাকা আবুল কাশেম, ১৮৮ নম্বরের মোহাম্মদ ইদ্রিস, ১৮৯ নম্বরের মোহাম্মদ ইয়াকুবসহ আরও অনেকে।
এছাড়াও তালিকায় ১৬৬ নম্বরে থাকা মো. খালেদের ঠিকানা পৌরসভার জামতল দেখানো হলেও তিনি মূলত পৌর এলাকার বাইরে পূর্ব কধুরখীল ইউনিয়নের বাসিন্দা।
তালিকার ১৮২ নম্বরে থাকা মো. লিটন ও হাছিনা বেগমের পিতা রহম আলী ফকির বাড়ির মো. ইউনুছ মিয়া। জানা গেছে তারা দুজন ভাই-বোন। আবার ১৮৪ নম্বরে থাকা মো. আব্দুল কাদের ও ১৮৫ নম্বরের আবু জাফরের পিতা আবুল কাশেম, তারাও সহোদর।
তালিকায় ২৪ নম্বরে আছেন আবু বক্কর। আবার ১০৪ নম্বরে আছেন তার স্ত্রী আছমা আক্তার। কৌশলে স্ত্রীর ঠিকানা দেখানো হয়েছে তার বাবার বাড়ি। তবে দুজনের মোবাইল নম্বর একই।
তালিকার অনেকেই দুই দফা চাল পেয়েছেন, কেউ একবার আবার কেউ কেউ একেবারেই না পাওয়ার বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কাউন্সিলর শাহজাদা মিজানুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছি। ওই আলোকে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে ডিলারদের মাধ্যমে ওএমএসের চাল বিক্রি হয়েছে। তবে কিছু কার্ড নিয়ে অভিযোগ আসছে। তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
কী সমাধান করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চাল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।’
তবে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদের সাথে যোগাযোগ শুরুর বিষয়টি স্থানীয় কাউন্সিলর জেনেছেন। জেনে যারা কার্ড ও চাল পায়নি তাদেরকে কার্ড ও চাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের কেউ কেউ তা গ্রহণ করলেও অনেকেই ফিরিয়ে দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। ডাকযোগে তার অনুলিপি পাঠিয়েছেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়েও।
উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসব কিছু দেখাশোনা করছেন উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা। অন্যদিকে আইসিটি কর্মকর্তা বললেন, চাল বিক্রির দায়িত্ব তার, কার্ডের অনিয়ম সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
তবে একাধিক কর্মকর্তা অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, অনিয়ম চোখের সামনে হয়েছে। আমরা দেশের অন্য জায়গা থেকে চাকরির সুবাদে এখানে থাকি। অনিয়ম দেখলেও কিছু বলতে পারিনি। আপনারা জেলা প্রশাসক স্যারসহ উর্ধ্বতন স্যারদের দৃষ্টিতে বিষয়টি আনুন। মানুষ উপকৃত হবে।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিনে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা পেয়ে বোয়ালখালী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে। এখানেও যদি অনিয়ম প্রমাণ হয় আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
সিপি